সম্পাদক সমীপেষু...

মিড ডে মিল: তত্ত্ব ও বাস্তব
খাবারের লোভ দেখিয়ে স্কুলছুটদের সংখ্যা কমিয়ে আনা এবং শিশুদের পুষ্টির কথা মাথায় রেখে আদালতের নির্দেশে বিদ্যালয় স্তরে দ্বিপ্রাহরিক আহারের ব্যবস্থা হয়েছে আজ বেশ কয়েক বছর। কিন্তু এই প্রাত্যহিক ভোজের আয়োজন করতে গিয়ে শিশুশিক্ষার মূল উদ্দেশ্যটি ব্যাহত হয়ে পড়ছে কি না, গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বোধহয় তার পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা আজও হয়নি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রপিছু ১০০ গ্রাম চাল, ১৫ গ্রাম ডাল, ৩ গ্রাম সর্ষের তেল, ৪ গ্রাম লবণ, ১ গ্রাম হলুদ এবং সবজি, মশলা জ্বালানি, ডিম ইত্যাদি বাবদ ১.৯৬ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। সপ্তাহে চার দিন ভাত আর দু’দিন খিচুড়ি এবং মাসে চার দিন আধখানা করে ডিম দেওয়ার নির্দেশ আছে। মনে রাখা হয়নি, গ্রামের ছেলেদের ১০০ গ্রাম চালের ভাত আর ১৫ গ্রাম ডালে পেট ভরে না।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (কোথাও কোথাও স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী) এই দৈনিক ভোজবাড়ি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন। মানুষ হিসেবে এঁরা সৎ এবং অসৎ দু’রকমই হতে পারেন। তিনি যদি সৎ হন, তা হলে জনপ্রতি ১.৯৬ টাকায় ৮০ টাকা মণ দরে জ্বালানি, ৩.৫০ টাকা দরে ডিম এবং অগ্নিমূল্য বাজারদরে সবজি কিনে পড়াশোনা শিকেয় তুলে ওই উটকো ঝামেলার হিসাব মেলাতে হিমশিম খাবেন এবং নষ্ট ডিম আর পচা চালকুমড়োর ঘাটতি মেটাতে তাঁর যখন কালঘাম ছুটবে, তখন সরকারি বরাদ্দের ঠিক খবর না-জানা অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত অভিভাবকের দল ‘মাস্টার সব টাকা মেরে নিচ্ছে’ অপবাদ দিয়ে প্রতিদিন হামলা করবে।
আবার অন্য দিকে, অসৎ শিক্ষকেরও অভাব নেই। যিনি প্রতিদিন ছাত্রছাত্রীদের প্রকৃত উপস্থিতি গোপন করে অনেক বেশি করে উপস্থিতি দেখাচ্ছেন। ডিম না-খাইয়ে ডিমের টাকা আত্মসাৎ করছেন। সুযোগ বুঝে রান্না বন্ধ রেখে খাতা-কলমে ‘রান্না হয়েছে’ দেখাচ্ছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ (তিনিই যে সৎ এ কথা কে বলল) সজাগ না-থাকলে এই আচার এবং অনাচার চলতেই থাকবে।
কিন্তু এহ বাহ্য। ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকদের আরও নানান মাথাব্যথা রয়েছে। যেমন, প্রতিদিন সকালে উঠে ব্যক্তিগত কাজকর্ম শিকেয় তুলে স্কুলের রান্নার জন্য সবজি ও অন্যান্য জিনিসপত্র কেনাকাটা করা, জ্বালানির খোঁজ করা (বিশেষ করে বর্ষায় যা দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য)। যে দিন ভাত রান্না হবে সে দিন সময় বেশি লাগবে বলে বেলা ৯টার সময় স্কুলের তালা খুলে রান্নার জিনিসপত্র রাঁধুনিদের বুঝিয়ে দেওয়া। ডিম রান্নার দিন ডিমের লোভে ঢুকে পড়া বহিরাগত উটকো ছেলেদের উৎপাত বন্ধ করা। আগাম বাজার ও রান্না হয় বলে এস্টিমেট ঠিক থাকে না, ফলে অপচয় নিয়ে দুর্ভাবনা করা ইত্যাদি।
তবু ছাত্রছাত্রীরা যে জন্য বিদ্যালয়ে যায়, সেই পঠনপাঠনের হাল কী রকম? টিফিনের জন্য বরাদ্দ সময় আধঘণ্টা। কিন্তু তার আগে থেকেই ক্লাসের মধ্যে শুরু হয়ে যায় টিনের থালা বাজানো। যে থালা তারা বাড়ি থেকে আনে ভাত বা খিচুড়ি খাওয়ার জন্য। ক্লাস টিচার না-থাকলে থালার আওয়াজে স্কুলে টেকা দায়। এর ফলে তিতিবিরক্ত শিক্ষকরা টিফিনের আগে বাড়ি গিয়ে থালা আনতে বললে তাতেও চলে যায় আধঘণ্টা। অনেকে টিফিনের সময় থালা ভর্তি খাবারদাবার নিয়ে সটান বাড়িমুখো হয়ে যায়। আর আসে না। ছাত্রসংখ্যা বেশি হলে রাঁধুনিরা পরিবেশন করতে পারে না। তখন উঁচু ক্লাসের ছাত্রদের দিয়ে পরিবেশন করানো হয়। তাতেও পঠনপাঠনের ক্ষতি হয়।
অধিকাংশ সময় শিশুদের রান্নার জন্য যে-চাল ঠিকাদাররা পাঠায়, তা খাওয়ার অযোগ্য, অস্বাস্থ্যকর। অথচ বাইরে থেকে দেখলে গোটা প্রক্রিয়াটা চলছে বেশ শান্তিতে। কেননা, প্রতি মাসে ‘বহু’ শিক্ষকের কিছু ‘উদ্বৃত্ত আয়’ হচ্ছে। এ সমস্ত ব্যাপার যাঁর নজরদারি করার কথা, তিনিও ‘আশ্চর্যজনক ভাবে’ অসম্ভব নীরব। যিনি চাল সরবরাহ করেন, তিনিও তলায় তলায় ফুলে-ফেঁপে উঠছেন।
পোকা-খাওয়া নিম্নমানের চাল খেয়ে ছাত্রছাত্রীদের দৈহিক পুষ্টি কতখানি হচ্ছে, তা গবেষণার বিষয়। কিন্তু প্রতিদিন স্কুলের ভোজবাড়িতে রান্নাবাড়ির তদারকি করতে গিয়ে শিক্ষকদের এবং টিনের থালা বাজিয়ে মহানন্দে হইহই করে খাওয়াদাওয়া সারতে গিয়ে ছাত্রদের পঠনপাঠনের অনেকটা সময় যে অপচয়িত হচ্ছেএই বিষয়টি গ্রামের কোনও স্কুলে এলেই প্রত্যক্ষ করা যাবে।
মিড ডে মিলের পিছনে সরকারের যে বিশাল অঙ্কের টাকা ব্যয় হয়, সেই টাকায় অনুন্নত এলাকার হতদরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের চিহ্নিত করে, তাদের জন্য ভাল পোশাক ও যথেষ্ট পরিমাণে প্যাকেটবন্দি পুষ্টিকর শুকনো খাবার দেওয়া সম্ভব। এর ফলে যেমন বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি রোধ করা যাবে, তেমনই এই অর্থব্যয়ের উপযোগিতাও বাড়বে। লক্ষ্য থেকে উপলক্ষটাই যদি বড় হয়ে ওঠে, তা হলে তো গল্পটা সেই ‘তোতাকাহিনি’-ই হল!
অন্য ভাবে
সিঙ্গুরের অসমাপ্ত ন্যানো কারখানার নিকটবর্তী একটি গ্রামের এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোনও সরকারি কাজে বন্ধু যখন যাবেন বললেন, আমি সঙ্গ নিলাম। বন্ধুর কাজ সারার ফাঁকে আমি বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে দেখছি ক্লাস হচ্ছে। একটি প্রায়ান্ধকার ক্লাসঘরে চোখ পড়ল, দেখি মাস্টারমশায়ের হাতে প্রকাণ্ড এক বেত। দরজায় মুখ বাড়িয়ে সহাস্য জিজ্ঞেস করি:
‘ওটা প্রয়োগ করতে হচ্ছে নাকি?’
‘হ্যাঁ, প্রয়োগ তো করতেই হবে।’
‘করতেই হবে? এখন যে ইস্কুলে মারধর করা হাইকোটের্র নির্দেশে বারণ!’
‘...!’
‘আপনি একটু অন্য ভাবেও ওটা প্রয়োগ করতে পারেন। ধরুন, ওটা দিয়ে টেবিলে বা দেওয়ালে জোরে শব্দটব্দ করলেন, ওরা চুপ করে যাবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ছাত্রছাত্রীদের মারলে হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করা হয়।’
‘...!’
এর কিছু পরে বন্ধুর কাজ শেষ হতে যখন বিদ্যালয় ছেড়ে বেরোচ্ছি, দেখি, সেই প্রায়ান্ধকার ক্লাসঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ হয়ে গেছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.