প্রবন্ধ ১...
তখন পাশাপাশি ছিলেন, এখন মুখোমুখি
বশেষে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী স্বীকার করে নিলেন, জ্ঞানেশ্বরী কাণ্ড নাশকতার ফল। স্মরণ করা যেতে পারে, মাওবাদীদের আক্রমণে এই রাজ্যে পুরসভা নির্বাচনের ঠিক দু’দিন আগে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসে নাশকতায় ১৬০ জন যাত্রী প্রাণ হারান, আহত হন আরও বহু। সারা দেশ এই নাশকতাকে মাওবাদীদের অপকর্ম হিসেবে চিহ্নিত করলেও, তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতাদেবীর বিস্ময়কর ঘোষণা ছিল যে, পুরসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসকে বেকায়দায় ফেলার জন্য সি পি আই এম এই অপকর্ম করেছে! আরও বিস্ময়কর ছিল বিদ্বজ্জনদের একাংশের প্রতিক্রিয়া। মাও-জে-দং একদা বলেছিলেন, তদন্ত ছাড়া কথা বলার অধিকার থাকে না। কিন্তু এই নাশকতার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই, তখনও উদ্ধার কাজ শেষ হয়নি, বহু মৃত ও অর্ধমৃত মানুষ রেল কামরায় আটকে আছেন, কোনও রকম তদন্ত ছাড়াই কলকাতায় বসেই আমাদের বিদ্বজ্জনরা রীতিমত সাংবাদিক সম্মেলন করে এই দায় সি পি আই এমের ওপরে চাপিয়ে ঘোষণা করে দিলেন যে, তৃণমূল কংগ্রেসকে হতমান করার জন্য যেহেতু সি পি আই এম এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তাই তাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য পুরসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থন করা উচিত। তার থেকেও ভয়ংকর কথা, যাঁরা এই অবস্থান নিতে রাজি ছিলেন না উপরোক্ত বিদ্বজ্জনদের অনেকেই তাঁদের ‘ভণ্ড’ ‘প্রতারক’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করেন!
আজ যখন খোদ মমতাদেবী মাওবাদীদের জ্ঞানেশ্বরী কাণ্ডের জন্য দায়ী করছেন, তখন এই সব মস্ত মস্ত মানুষের বক্তব্য জানার কৌতূহল স্বাভাবিক। কিন্তু আপাতত তাঁরা চুপ। হয়তো লোকস্মৃতি ক্ষণস্থায়ী বিবেচনায় কিছু দিন নীরব থেকে আবার অন্য কোনও বিষয়ে একই ভাবে গলাবাজি করবেন।
এই খুচরো বিষয়ের থেকেও আশ্চর্যজনক হল জ্ঞানেশ্বরী কাণ্ডে মমতাদেবীর অবস্থান বদল। তিনি রাজনীতির লোক, রাজনৈতিক প্রয়োজনে প্রায়শই ‘ম্যান-মেড বন্যা’ ‘আইলা-লাইলা’ জাতীয় কথা বলে থাকেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত নিজের ভুল বক্তব্য সংশোধনের কোনও তাগিদ কোনও দিন দেখা যায়নি। ঘটনা হল, মমতাদেবীর রাজনৈতিক জীবনে এমন আত্মখণ্ডন অভূতপূর্ব। রাজনৈতিক ক্ষমতালাভই কি এই পরিবর্তনের কারণ? স্মরণ করা যেতে পারে, রাজ্যে বামপন্থীরা বিরোধী অবস্থানে থেকে যে-সব কথা বলতেন, ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সে-সব কথা অনেক ক্ষেত্রেই পালটে যায়। সেই ইতিহাসই কি মমতাদেবীর ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্ত হতে চলেছে?
একটু তলিয়ে ভাবলেই কিন্তু মমতদেবীর অবস্থান বদলের কারণ বোঝা কঠিন নয়। বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন তাঁর ক্ষমতালাভের পথে প্রধান অন্তরায় ছিল সি পি আই এম। তাই, ‘মারি অরি, পারি যে কৌশলে’ লাইন নিয়ে তিনি পাখির চোখের মতো সি পি আই এমকে টার্গেট করেন। এই অন্ধ সি পি আই এম বিরোধিতাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় পুঁজি। যা বলছেন তা ভুল হলেও, সি পি আই এম বিরোধিতার কারণে তা ছিল তাঁর কাছে ‘রাজনীতিগত ভাবে ঠিক’। ভুল সংশোধনের তাগিদ তাই তাঁর ছিল না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। ক্ষমতা সংহত করার পথে বড় কাঁটা হল জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের দাপট। তাই মুখ্যমন্ত্রী এখন মাওবাদীদের টার্গেট করেছেন। জ্ঞানেশ্বরী কাণ্ডে অবস্থান বদল তারই ফল।
মাওবাদী প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থান বদল কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অনেক দিন ধরেই তাঁর ভাষা বদলে গিয়েছে। আগে তিনি বলতেন, ‘মাও-ফাও বলে কিছু নেই’ ‘মাওবাদীদের নাম নিয়ে সি পি আই এমই জঙ্গলমহলে খুনখারাপি করছে’ ইত্যাদি। লালগড়ের জনসভায় তিনি প্রকাশ্যে যৌথবাহিনী প্রত্যাহারের, রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির, কমরেড আজাদের হত্যার তদন্ত দাবি করেছেন। মাওবাদীরাও প্রকাশ্যে ঘোষণা করে মমতাদেবীকে ‘মুখ্যমন্ত্রী’ চেয়েছেন। কিন্তু এখন ছবি বদলে গিয়েছে। মমতাদেবী এখন মাওবাদীদের ‘ডাকাত’, ‘খুনি’, ‘জঙ্গল মাফিয়া’, ‘সুপারি কিলার’ আখ্যা দিয়েছেন, প্রকাশ্যে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। তাঁর গলায় এখন বুদ্ধদেবের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। মাওবাদীরাও পুরনো সখ্য ভুলে ‘হার্মাদ’দের বদলে ‘ভৈরববাহিনী’কে টার্গেট করেছে। হিট লিস্টে মমতাদেবী-সহ মন্ত্রী-নেতাদের নাম তুলেছে। স্পষ্টতই, আগে মমতাদেবী ও মাওবাদীরা পাশাপাশি ছিলেন, এখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গিয়েছেন।
আসলে মমতাদেবী ও মাওবাদীরা উভয়েই অন্ধ সি পি আই এম বিরোধিতার অভিন্ন ভিতের ওপর ছিলেন। ফলে, সি পি আই এমের গলার কাঁটা মাওবাদীদের কাজকর্মে মমতাদেবী উল্লসিতই ছিলেন, আবার মাওবাদীদের প্রত্যাশা ছিল যে, মমতা মুখ্যমন্ত্রী হলে প্রতিশ্রুতি মতো রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি ঘটবে, যৌথবাহিনী প্রত্যাহার করা হবে, পশ্চিমবঙ্গের নিরাপদ পশ্চাদ্ভূমি ব্যবহার করে সর্বভারতীয় স্তরে তাঁদের বিস্তৃতির পথ প্রশস্ত হবে। তাঁদের কোনও আশাই পূর্ণ হয়নি। বন্দিমুক্তি হয়নি, যৌথবাহিনী প্রত্যাহারের চিহ্ন নেই, আজাদের হত্যা-তদন্ত নিয়ে কোনও কথা নেই। উপরন্তু, মাওবাদীদের বাদ দিয়ে পুরনো পি-এম টু ডি-এম লাইন অনুসরণ করে মুখ্যমন্ত্রী সি-এম টু ডি-এম লাইন ধরে সরাসরি জনসাধারণের জন্য প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই, মাওবাদীরা এই ঘোষণাকে তাদের বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস ভেবেছেন। পাশাপাশি, এত দিন সি পি এমের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা ‘হার্মাদ’রা ভৈরববাহিনীতে জড়ো হয়ে জঙ্গলমহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমি দখলের পথ প্রশস্ত করেছেন। ফলে রচিত হয়েছে তাঁর সঙ্গে মাওবাদীদের সংঘর্ষের পটভূমি।
মাওবাদী মোকাবিলায় মমতাদেবী তিনটি পথ বেছে নিয়েছেন: দমন, তোষণ, উন্নয়ন। দমনের জন্য যেমন রয়েছে যৌথবাহিনীর সদা উদ্যত খড়্গ, তেমনই মাওবাদী হামলায় নিহতদের লাশ কলকাতায় এনে জনমত পক্ষে আনার প্রচেষ্টা। তোষণের জন্য উদার হস্তে প্যাকেজ বিতরণের প্রতিশ্রুতি, অন্য দিকে সরকারি মধ্যস্থ নিয়োগ করে শান্তি প্রক্রিয়া। ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে, প্যাকেজের প্রলোভন কার্যকর হয়নি, শান্তি প্রক্রিয়াতেও মমতা তেমন আস্থাশীল নন। আসলে মমতাদেবী কার্যকর শান্তি প্রক্রিয়ায় গুরুত্ব দিলে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ছত্রধর মাহাতো, সুশীল রায়, কোবাড গাঁধী বা নিদেনপক্ষে গৌর চক্রবর্তীর কথা ভাবতেন। এঁদের কারও বিরুদ্ধে খুনের কোনও কেস নেই। আলোচনাসাপেক্ষে তাঁদের মুক্তি দিলে যেমন সরকারের শুভেচ্ছা প্রদর্শিত হত, তেমনই অন্য দিকে শান্তি প্রক্রিয়া উন্মোচিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবলতর হতে পারত।
মমতাদেবী অনেক বেশি আস্থা রেখেছেন উন্নয়নের প্যাকেজে। সে কারণেই শুভেন্দু অধিকারী ঘোষণা করছেন যে, উন্নয়নের কার্যক্রমের ফলে মাওবাদীরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় অনেকেই আত্মসমর্পণ করছেন। কিন্তু মাওবাদীরা জনবিচ্ছিন্ন উন্নয়ন প্রক্রিয়ার ফলে নয়, বরং নিজ গুণেই তাঁদের বিচ্ছিন্নতা এসেছে। আসলে মাওবাদীদের সবচেয়ে বড় শত্রু মাওবাদীরা নিজেরাই। অস্ত্র-নির্ভরতার কারণে তাঁদের মানুষের ওপর নির্ভরতা কমেছে, জনসাধারণের সঙ্গে গণতান্ত্রিক সম্পর্কের বদলে তাঁরা ক্রমেই জোরজবরদস্তির পথ ধরেছেন। এর ওপর বাবু বোস ও লালমোহন মাহাতোর মতো জনপ্রিয় নেতাদের নির্বিচার হত্যা মাওবাদীদের বিচ্ছিন্ন করেছে। মমতাদেবীর অন্যতম মহৎ গুণ হল, তিনি মানুষের নাড়ি বোঝেন। জনসাধারণের এই মনোভাব বুঝেই তিনি হুংকার ছাড়তে শুরু করেছেন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও বলতেই হয় যে, উন্নয়ন সম্পর্কে মমতাদেবীর ধারণা ভ্রান্ত। উন্নয়ন এক গণ-আন্দোলন। সাধারণ মানুষের উদ্যোগ, সক্রিয়তা, সৃষ্টিশীলতা উন্মোচিত না করে আকস্মিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ জন্যই প্রয়োজন ছিল স্থানীয় মানুষের ক্ষমতায়ন। জনগণের নির্বাচিত সংস্থাগুলির প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতায়ন ছাড়া উন্নয়ন গল্পকথা হয়েই থাকবে। সেখানে আমলানির্ভর উন্নয়নের যে ছক মমতাদেবী অনুসরণ করছেন, তার সাফল্যের সম্ভাবনা নেই। বরং সেটা অনেকাংশে বুদ্ধবাবু অনুসৃত শিল্পায়নের ছককেই মনে করিয়ে দেয়।
লক্ষণীয়, জঙ্গলমহলের উন্নয়নে জঙ্গল মহা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলেও মমতাদেবীর উন্নয়ন পরিকল্পনায় তা অনুপস্থিতপ্রায়। অরণ্যের অধিকারের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু কী ভাবে এই অধিকার সুনিশ্চিত করা হবে তার কোনও রূপরেখা নেই। ফলে তা শহুরে বাবুবিবিদের কথার কথা হয়ে পড়েছে। আসলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে ২০০৬ সালের আইন ধরেই ‘কমিউনিটি ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট’-এর কথা বলা যেত। ওই আইন ধরেই দেশে যে ‘জয়েন্ট ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট’ ব্যবস্থা চালু হয়েছে, তাতে জঙ্গলবাসীদের জঙ্গলসমূহের মাত্র ২৫ শতাংশ দেওয়া হলেও, তার ফলে যে জঙ্গলের এবং জঙ্গলবাসীদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। এর কারণ, জঙ্গলের মূল সম্পদের ২৫ শতাংশ পেলেও গৌণ সম্পদ অর্থাৎ পাতা, ফলমূল ইত্যাদির অধিকার অর্জনের ফলে জঙ্গলবাসীর জীবনযাপন সহজ হয়েছে। কমিউনিটি ম্যানেজমেন্ট এবং একশো দিনের কাজের প্রকল্প চালু হলে জঙ্গল ধরেই বহু শ্রমদিবস তৈরি হবে, জঙ্গল ও জঙ্গলবাসীর সমৃদ্ধি ঘটবে। মমতাদেবীর উন্নয়ন পরিকল্পনায় এ সব বিষয় উপেক্ষিত। ফলে উন্নয়ন নিয়ে মাওবাদীদের বিচ্ছিন্ন করার সম্ভাবনা নেই।
তাই শেষ পর্যন্ত দমনের হাতিয়ারকেই আশ্রয় করতে হবে। কিন্তু দমন দিয়ে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ইতিহাস বলছে, দমনের পথ ধরার পরে ছত্তীসগঢ় রাজ্যের তিন-চতুর্থাংশ এবং ঝাড়খণ্ডের অর্ধেক মাওবাদীদের দখলে গেছে। তা ছাড়াও, মাওবাদী সমস্যা সর্বভারতীয় প্রশ্ন। কোনও একটি রাজ্যে দমনের পথে এর সমাধানের সম্ভাবনা শূন্যপ্রায়। মাঝ থেকে এই দমন অভিযানের রেশ পড়বে সারা রাজ্যে। এই দমনের পথেই বিপন্ন হবে আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা, আক্রান্ত হবে সমাজের গণতান্ত্রিক কাঠামো। ব্যক্তির ইচ্ছানিরপেক্ষ ভাবে এই প্রক্রিয়া অনিবার্য হবে। মমতাদেবী প্রশাসনে সিদ্ধার্থ-জমানার নৃশংসতা আনয়নে বাধ্য হবেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.