প্রায় আট বৎসর পূর্বে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপায়ী পেনশন ফান্ড রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি নামক প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করিয়াছিলেন। তাহার পর, মজিয়া যাওয়া যমুনায় বেশি জল না বহিলেও দেশে দুই দফা লোকসভা নির্বাচন হইয়া গিয়াছে। এত দিনে কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠানটিকে বিধিবদ্ধ (স্ট্যাটুটরি) প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দিতে আগ্রহ করিল। সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে এই আইনটি পাশ করাইবার চেষ্টা হইবে। অবশ্য, কাজটি সহজ হইবে না। অনুমান করা চলে, বামপন্থী এবং ভারতীয় জনতা পার্টি, উভয় শিবির হইতেই বিবিধ আপত্তি উঠিবে। বামপন্থীরা এখনও এই প্রশ্নে চুপ করিয়া আছেন বটে, কিন্তু পেনশন সংস্কারে তাঁহাদের চিরকালীন আপত্তি। ভারতীয় জনতা পার্টিও আপত্তি করিবে। তাহার একটি কারণ, এন ডি এ-র আমলের অর্থমন্ত্রী যশোবন্ত সিংহের নেতৃত্বে স্ট্যান্ডিং কমিটি এই বিলের ক্ষেত্রে যে মতামত দিয়াছিল, কেন্দ্রীয় সরকার তাহার দুইটি মত মানে নাই। কিন্তু, বি জে পি যদি সেই কারণে গোঁসা করিয়া বিলটির বিরোধিতা করে, তাহা হাস্যকর হইবে। কারণ, প্রতিষ্ঠানটির জন্ম তাহাদের শাসনকালেই।
বিলটি লইয়া অসন্তোষের কারণ স্পষ্ট কেন্দ্রীয় সরকার পেনশন তহবিল বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রিটার্ন বা লাভের কোনও ন্যূনতম হার বাঁধিয়া দিতে নারাজ। দাবিটিই অবান্তর। তহবিলের অর্থ যেখানে শেয়ার বাজারে খাটিবে, সেখানে লাভের ন্যূনতম হার বাঁধিয়া দেওয়ার অর্থ, বিপদকে আমন্ত্রণ জানাইয়া রাখা। ভারতে এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড বা কর্মী ভবিষ্যনিধি প্রকল্প যে বিপদের মুখে পড়িয়াছে, তাহার কারণ এই ন্যূনতম লাভের হার বাঁধিয়া রাখা। ভবিষ্যনিধি প্রকল্পে বাঁধা হারে সুদ দিতেই হইবে, এবং সেই হার বাজারচলতি হারের তুলনায় বেশি হইতে হইবে এমন একটি অসম্ভব মানসিকতা বিশ্বের বৃহত্তম ভবিষ্যনিধি প্রকল্পকে বিপদের সম্মুখীন করিয়াছে। পেনশন তহবিলের ক্ষেত্রে একই ভুল না করাই বিধেয়। বরং বিনিয়োগকারী, অর্থাৎ পেনশন প্রাপকদের একটি বিকল্প দেওয়া প্রয়োজন তাঁহারা অধিক লাভ এবং অধিক ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ার বাজারেও বিনিয়োগ করিতে পারেন, আবার নিজেদের তহবিল কম লাভের কিন্তু ঝুঁকিহীন ঋণপত্রেও ঢালিতে পারেন। তাহাতে প্রাপকের চয়নের অধিকারটিও বজায় থাকে, আর সংস্কারের প্রক্রিয়াটিও যথার্থ পথে চলিতে পারে।
পেনশন তহবিল সংস্কারের প্রক্রিয়াটি বহু বিলম্বে হইলেও গতিশীল হইতেছে। খুচরা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি পুঁজি, কিছু শর্তসাপেক্ষে, অনুমোদন পাইতেছে। কিন্তু, এই বিলম্ব, এই শর্ত প্রমাণ করে, ভারতে আর্থিক সংস্কার এখনও রাজনৈতিক ভাবে কতখানি বিপজ্জনক। রাজনৈতিক নেতারা যদি সংস্কারের মাহাত্ম্য আন্তরিক ভাবে বুঝিতেন, তবে তাঁহারা সংস্কারের অনুকূলে জনমত গড়িয়া তোলার প্রয়াস করিতেন। কিন্তু, ১৯৯১ সালের পর দুই দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পরও সংস্কার এই দেশের নেতাদের নিকট তিক্ত ঔষধের ন্যায় উপকারী, কিন্তু অতি অপছন্দের। এই মনোভাবটি ত্যাজ্য। যে সংস্কারগুলি আরম্ভ হইয়াছে, সেগুলিকে গতিশীল করিতে হইবে। শ্রম আইন সংস্কারের ন্যায় অতি জরুরি কাজ শুরু করিতে হইবে। দায়ে পড়িয়া নহে, সংস্কারের গুরুত্ব বুঝিয়াই কাজগুলি করা প্রয়োজন। |