সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হইয়াছে বয়কটের হুমকি দিয়া। প্রথম দিনেই বিরোধীদের হই-হট্টগোলে অধিবেশন ভণ্ডুল হইয়া গিয়াছে। বাকি দিনগুলিতেও অধিবেশন মসৃণ ভাবে চলিতে দেওয়া হইবে, এমন আশা কম। বিরোধী পক্ষ আগাম হুমকি দিয়াই রাখিয়াছে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পালনিয়াপ্পন চিদম্বরম সংসদে কিছু বলিতে উঠিলেই তাঁহারা সভা বয়কট করিবেন। চিদম্বরমের বিরুদ্ধে তাঁহাদের অভিযোগ, তিনি টু-জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারিতে জড়িত, অতএব তাঁহাকে মন্ত্রিত্ব হইতে অপসারিত করিতে হইবে, অন্যথায় তাঁহারা চিদম্বরম বলিতে উঠিলেই সভাকক্ষ ত্যাগ করিবেন। ইহাই তাঁহাদের প্রতিবাদের প্রকরণ। স্বভাবতই শাসক দলের সাংসদরাও এই পরিস্থিতিতে নীরবে বসিয়া থাকিবেন না। হইচই, গোলমাল ও অচলাবস্থার আশঙ্কা অতএব থাকিয়াই যায়।
চিদম্বরম দুর্নীতিতে জড়িত কি না, তাহা নির্ণয়ের স্থান সংসদ নয়, আদালত। সাধারণ ভাবে যদি বিরোধীদের তাঁহার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ থাকে, তবে তাহা লইয়া সংসদের ভিতরে সংসদীয় বিধি ও রীতি অনুসারে আলোচনা চলিতে পারে। বস্তুত, সংসদ আলাপ-আলোচনারই গণতান্ত্রিক মঞ্চ, বয়কটের মতো নেতিবাচক ক্রিয়াকলাপের নয়। জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট যে কোনও বিষয়ই স্পিকারের অনুমোদনসাপেক্ষে জনপ্রতিনিধিসভায় উত্থাপিত, আলোচিত, বিতর্কিত হইতে পারে। সংসদে যে বিভিন্ন বিষয় লইয়া সরকার বিল আনে, তাহা লইয়াও তর্কবিতর্ক, আলোচনা, প্রশ্নোত্তর চলা উচিত। প্রায়শ কিন্তু দেখা যায়, গুরুত্বপূর্ণ জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট সেই সকল বিল লইয়াও বিতর্ক বা আলোচনার কোনও আগ্রহ বিরোধী পক্ষ দেখাইতেছে না। চলতি অধিবেশনেই যেমন জনলোকপাল বিল, জমি-অধিগ্রহণ বিল, খাদ্য-নিরাপত্তা বিল, শিক্ষা বিল, বিচারবিভাগের দায়বদ্ধতা সংক্রান্ত বিল সহ মোট ৫৪টি বিল সরকারের সংসদে পেশ করার কথা। অনেক বিলই বিতর্কিত হইবার মতো, কেননা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তরফে ইতিমধ্যেই বিলের বিভিন্ন ধারা লইয়া প্রবল আপত্তি ও মতভেদ জ্ঞাপন করা হইয়াছে। কিন্তু সে জন্য সংসদে পর্যাপ্ত সময় চাই, চাই আলোচনার উপযুক্ত পরিবেশ। হট্টগোল কিংবা বয়কট তাহাতে বিঘ্নই সৃষ্টি করে। এ জন্যই প্রধানমন্ত্রী সব দলকে সংসদের অধিবেশন মসৃণ ভাবে চালাইতে দিবার অনুরোধ করিয়াছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ভারতের মতো পরিপক্ব গণতন্ত্রেও সংসদ বয়কটের মতো নেতিবাচক অর্বাচীনতা অনুশীলিত হইতেছে। প্রসঙ্গত, প্রতিবেশী বাংলাদেশে সংসদীয় বিরোধী দল পারতপক্ষে সংসদে যোগই দেয় না, বিরোধী পক্ষে অবস্থানের সমগ্র মেয়াদটাই সংসদ বয়কট করিয়া অসংসদীয় রাস্তার আন্দোলনে অতিবাহিত করিয়া দেয়। গত কয়েক বছরে ভারতের সংসদও এই নিষ্ক্রিয় নেতিবাচকতা দেখিয়াছে। কোনও না কোনও বিষয়ে প্রতিবাদের অছিলায় বিরোধীরা প্রতি দিন সভাকক্ষ ত্যাগ করিয়াছেন কিংবা সভা মুলতুবি রাখিতে বাধ্য করিয়াছেন। ফলে সংসদ জরুরি আলোচনা ও বিতর্ক হইতে বঞ্চিত হইয়াছে, নির্বাচকমণ্ডলীও বিভিন্ন জনস্বার্থবিষয়ক প্রশ্নে তাঁহাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বক্তব্য বা অবস্থান জানিতে পারেন নাই। শাসক জোটের সুস্পষ্ট গরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও বহু দরকারি বিল পেশ হইতে পারে নাই কিংবা পেশ হইলেও পাশ হইতে পারে নাই। এ ধরনের নেতিবাচকতা, সভা ভণ্ডুল করার কিংবা মুলতুবি করার জবরদস্তি এক হিসাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ঘাতের শামিল। অথচ গণতন্ত্রের দোহাই পাড়িয়াই বিরোধীরা ইহা করিয়া থাকেন। এ ব্যাপারে কোনও দলই ধোয়া তুলসীপাতা নয়, যে-দল যখন বিরোধী পক্ষে থাকে, সে-দলই এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করিয়া থাকে। সদ্য শুরু হওয়া শীতকালীন অধিবেশনটিকে বিভিন্ন জরুরি বিল ও সংশোধনী লইয়া আলোচনার অনুকূল করিয়া তোলার দায় সাংসদদেরই। সেই দায় পালনের জন্যই জনসাধারণ তাঁহাদের সংসদে পাঠাইয়াছেন। অতএব কর্তব্যচ্যুত হইবেন না। |