মেয়েকে বাঁচান, জ্বলন্ত কামরার দরজায় মিনতি করছিলেন মা
মন একটা দৃশ্য দেখতে হবে দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি কোনও দিন!
দাউদাউ করে জ্বলছে কামরাটা। জানলা-দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছে আগুন। আর সেই আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে হাউহাউ করে কাঁদছেন এক মহিলা। জনে জনে কাকুতিমিনতি করছেন, “আমার মেয়ে ভিতরে রয়েছে! দয়া করে ওকে বাঁচান!”
কে কার কথা শোনে! সবাই নিজের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত। মহিলা এক বার ছুটে যাচ্ছেন আগুনের দিকে। আবার কাঁদতে কাঁদতে ফিরে আসছেন সাহায্যের জন্য।
আহত যাত্রী লক্ষ্মী রাংকা
নিজে এর কিছুক্ষণ আগেই নেমে পড়েছি ওই জ্বলন্ত ট্রেন থেকে। ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে ঠেলে তুলেছিল আমার স্বামী, সুনীল। ঘুম চোখে শুনেছিলাম ও বলছে, “কামরায় আগুন লেগেছে। তাড়াতাড়ি নেমে পড়ো।”
প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। কিন্তু চোখ খুলতেই টের পেলাম ধোঁয়ার ভরে গিয়েছে কামরা। চোখ জ্বালা করছিল। পোড়া গন্ধও পাচ্ছিলাম। সবাই বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। ছুটছেন দরজার দিকে। আমিও পড়িমড়ি করে দৌড়লাম। কিন্তু কোন দিকে দরজা? সঙ্গের মালপত্র বার্থের নীচে রেখেই আমি আর আমার স্বামী বেরোনোর দরজা খুঁজছি। কামরার ওই সরু জায়গায় ধাক্কাধাক্কি করছেন সবাই। ধোঁয়ায় প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এ দিকে আগুনের হলকা গায়ে লাগতে শুরু করেছে। এক এক বার মনে হচ্ছিল, দরজা পর্যন্ত পৌঁছতে পারব না। তার আগেই আগুন আমাদের শেষ করে ফেলবে।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য দরজাটা খুঁজে পেলাম। কামরা থেকে সোজা ঝাঁপ দিলাম নীচে। পড়ে গেলাম, পায়ে চোট লাগল। কিন্তু তাতে কী? ওই কামরা থেকে তো বেরোতে পেরেছি। দেখি, আমার স্বামীও দরজা থেকে লাফ দিয়ে নেমে এসেছে। বুঝলাম বেঁচে গিয়েছি। খুব জোর বেঁচে গিয়েছি।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে প্রথমে কিছু ঠাহর করতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুনতে পেলাম একটা বিস্ফোরণের শব্দ। দেখি কামরার মধ্যে দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে শুরু করেছে। ভাবতেই অবাক লাগছিল, ওই কামরাতেই আমরা কয়েক মিনিট আগে ঘুমোচ্ছিলাম। এতক্ষণে নিশ্চয়ই পুড়ে কাঠ হয়ে যেতাম। মনে হল এক বার চিমটি কেটে দেখি, সত্যি বেঁচে আছি তো!
একটু ধাতস্থ হওয়ার পর বুঝলাম, আমরা আছি একটা টিলার মতো জায়গায়। উল্টো দিকে বোধহয় জঙ্গল। একটু আগে আগুনের হলকা লাগছিল আর এখন হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। ট্রেনের বাইরে তখন ভয়ার্ত মুখে ছুটোছুটি করছেন সবাই। চিৎকার করে খুঁজছেন নিজের লোককে। এর মধ্যে বি-২ কামরাটিতেও আগুন লেগে গিয়েছে। অসহায় ভাবে তাকিয়ে দেখছি, যে ট্রেনে করে ছেলের কাছে পৌঁছনোর কথা ছিল, তার দু’টি কামরা গিলে নিয়েছে আগুন। কত মানুষ ভিতরে আটকে পড়েছেন, কে জানে! জানলা দিয়ে দেখলাম, এক মহিলার সারা শরীরে আগুন জ্বলছে। তিনি বাইরে আসার জন্য কামরার ভেতর ছুটোছুটি করছেন। তার পরই শুনলাম, কামরার ভিতর থেকে শিশুর আর্তনাদ। চিৎকার করে বললাম, “ওদের বাঁচান।” কিন্তু হাজারো মানুষের চিৎকারে আমার আওয়াজ কেউ শুনতে পেল না। কেউ এগিয়েও গেল না ওদের বাঁচাতে।
এর মধ্যে ঘটনাস্থলে এসে পড়েছেন ট্রেনের চালক ও গার্ড। অগ্নিদগ্ধ কামরা দু’টিকে বাকি ট্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন তাঁরা। কিছু ক্ষণের মধ্যেই স্থানীয় পুলিশ এসে পৌঁছল। পুলিশই গাড়ি করে আমাদের পারসনাথে পৌঁছে দিল। সেখান থেকে ধানবাদে গিয়ে কোলফিল্ড এক্সপ্রেসে করে হাওড়ায় পৌঁছেছি। এই পর্যন্ত রেলের তরফে কোনও সহযোগিতা করা হয়নি।
দেরাদুন যাওয়ার জন্য স্বামীর সঙ্গে সোমবার রাতে দুন এক্সপ্রেসে চেপেছিলাম। বি-১ কামরার ৫১ আর ৫৪ নম্বর বার্থ দু’টি ছিল আমাদের। ছেলে দেরাদুনে একটি স্কুলে পড়াশোনা করে। ওর সঙ্গেই দেখা করতে যাচ্ছিলাম। ছেলের কাছে পৌঁছনো তো দূরের কথা। ওকে দুর্ঘটনার খবরটা পর্যন্ত দিতে পারিনি। কারণ মোবাইল থেকে গিয়েছে বি-১ কামরায়। কাঁকুড়গাছির বাড়িতে পৌঁছনোর পরে ছেলেকে জানাতে পারব, ফিরে এলাম মৃত্যুর মুখ থেকে। একের পর এক ট্রেন দুর্ঘটনার খবর, ট্রেনে আগুন লেগে অনেক মানুষের মারা যাওয়ার খবর জানতে পারি সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু কেউ কি কখনও ভাবে যে এমন একটা ঘটনা, তার নিজের জীবনে কোনও দিন ঘটবে! অভিশপ্ত কামরাটা থেকে বেরোনোর জন্য বার্থ থেকে নেমে যখন স্বামীর সঙ্গে দরজার দিকে ছুটছিলাম, তখন এই কথাটাই মনে হচ্ছিল বারবার।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.