আবদার না-মেনে দুই মেয়েকে হারিয়ে আফসোস দুই বাবার
দুই পিতা আর দুই শিশুকন্যা।
দু’টি শিশুর আবদার আর দুই বাবার সেই আবদার রাখতে না-পারা।
এইটুকু ফাঁকেই ঘটে গেল ট্র্যাজেডি।
দুন এক্সপ্রেসের অগ্নিকাণ্ডের পরে এক পিতার অসহায় আফসোস, মেয়ের আবদার মেনে ওই রাতে কেন তাকে ট্রেনের বার্থে নিজের কাছে রাখলেন না তিনি!
আর এক পিতার বারবার মনে হচ্ছে, মেয়ের বায়না শুনে তিনি স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে থাকলে মেয়েটাকে হয়তো বাঁচাতে পারতেন।
দুই স্টেশন চত্বরে ভিড় করা জনতার কাছে কন্যাহারা এই দুই পিতাই যেন দুন এক্সপ্রেসের অগ্নি-ট্র্যাজেডির প্রতীক। প্রথম জন সেনাবাহিনীর জওয়ান মহম্মদ আকমন আলি। অন্য জন আসানসোলের একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী অজয় কুমার।

অর্চিতার বাবা অজয় কুমার।
ছবি: শৈলেন সরকার

মেহজুবির বাবা মহম্মদ আকমন।
ছবি: চন্দন পাল
আকমন স্ত্রী ও দুই মেয়ের সঙ্গে ওই ট্রেনে উঠলেও নিজে ছিলেন অন্য কামরায়। আগুন লাগার পরে পরিবারের বাকিরা কামরা থেকে বেরিয়ে এলেও বেরোতে পারেননি তাঁর বড় মেয়ে, আট বছরের মেহজুবি। আর অজয় কুমার স্ত্রী ও চার বছরের মেয়েকে আসানসোল স্টেশনে তুলে দিয়েছিলেন ওই ট্রেনে। মেয়ে বায়না ধরেছিল, বাবাও সঙ্গে চলুক। কিন্তু যেতে পারেননি অজয়। আগুন লাগার পরে ট্রেনের কামরায় ঠেলাঠেলিতে কাছছাড়া মেয়ে অর্চিতাকে খুঁজে নিয়ে আর কামরা থেকে বার করতে পারেননি অজয়ের স্ত্রী অন্নুদেবী। স্ত্রীর ফোনে দুঃসংবাদ পেয়ে সকালেই অজয় পৌঁছে যান গোমো স্টেশনে।
এ দিন সকালে ধানবাদ স্টেশনের রিটায়ারিং রুমের সামনে ধ্বস্ত দেহে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে একটাই কথা বলছিলেন আকমন আলি। “বড় মেয়েটা সব সময় আমার কাছে থাকতে চাইত। কাল রাতেও বলছিল, ‘পাপা আমি তোমার বার্থে শোব।’ বুঝিয়ে বলি, ‘কাল সকালেই তো তোমার সঙ্গে খেলব।’ এখন মনে হচ্ছে, কেন মেয়েটাকে সঙ্গে রাখলাম না। তা হলে হয়তো এ ভাবে হারাতে হত না ওকে।”
মালদহের রতুয়ার বটতলা গ্রামের বাড়িতে ঈদুজ্জোহার ছুটি কাটিয়ে দুন এক্সপ্রেসেই সপরিবার হরিদ্বারে কর্মস্থলে ফিরছিলেন আকমন। ‘অভিশপ্ত’ বি-১ কামরার দু’টি বার্থে শুয়ে ছিলেন তাঁর স্ত্রী শবনম এবং দুই মেয়ে আট বছরের মেহজুবি আর চার বছরের জেসমিন। কোলেরটিকে নিয়ে নীচের বার্থে শুয়ে ছিলেন শবনম। উপরের বার্থে মেহজুবি। আকমনের টিকিট ছিল পাশের বি-২ কামরার। রাতে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়ার পরে সেখানেই শুতে চলে যান তিনি। আগুন লাগার পরে সকলে নেমে এলেও ছোট্ট মেহজুবি ট্রেনের কামরা থেকে বেরোতে পারেনি। অসহায় ভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে সেই কামরা দাউদাউ করে জ্বলতে দেখার দৃশ্য থেকে এ দিন সকালেও কিছুতেই বেরোতে পারছিলেন না আকমন।
এ দিন সকালে রিলিফ ট্রেনে এই পরিবারটি ধানবাদ স্টেশনে ফেরার পরে কোনও মতে কথা বলছিলেন আকমন। তাঁর স্ত্রী শুধুই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। আর কী ঘটে গিয়েছে, বুঝতে না-পেরে মাকে ক্রমাগত প্রশ্ন করে চলেছে ছোট্ট জেসমিন।
গোমো স্টেশনে অজয় কুমারের পরিবারের ছবি খুব একটা আলাদা নয়। আত্মীয়ের বিয়ে উপলক্ষে মেয়েকে নিয়ে লখনউ যাচ্ছিলেন অজয়ের স্ত্রী অন্নুদেবী। অজয় জানালেন, আগুন লাগার সময় কামরার ভিতরে ছোটাছুটি-ধাক্কাধাক্কিতে ট্রেনের বাইরে পড়ে গিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী। তার পরে আর ভিড় ঠেলে মেয়ের কাছে পৌঁছতে পারেননি। এ দিন দুপুরে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে কিছুতেই মেয়ের দেহের পাশ ছেড়ে সরতে চাইছিলেন না ওই মহিলা। অজয় বললেন, “ট্রেন ছাড়ার সময়েও মেয়েটা আমার গলা জড়িয়ে ছিল। বারবার বলছিল, ‘বাবা তুমিও চলো না!’ এখন মনে হচ্ছে, আমি থাকলে হয়তো ওকে বাঁচাতে পারতাম।” শোকে বেসামাল অন্নুদেবীকে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন রাঁচি থেকে আসা আত্মীয়স্বজন।
বিকেলে ফিরতি দুন এক্সপ্রেসে আহত অবস্থায় যে-সব যাত্রী হাওড়া স্টেশনে ফিরে এলেন, তাঁদের কথাতেও বারবার ফিরে আসছিল এই দু’টি শিশুর কথা। রায়গঞ্জের প্রৌঢ় দম্পতি পরিমল ও মিনতি সরকার হরিদ্বারে বেড়াতে যাচ্ছিলেন। কোনও মতে ট্রেনের ভাঙা জানলা দিয়ে বেরিয়ে বেঁচে গিয়েছেন তাঁরা। দু’জনেই পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছেন। পরিমলবাবু বারবার বলছিলেন, “ফুটফুটে দু’টো বাচ্চাকে কিছু ক্ষণ আগেই কত আদর করছিলাম। চোখের সামনে তাদের জ্বলতে দেখেও কিচ্ছু করতে পারলাম না। এই আফসোস জীবনেও যাবে না।”
ধানবাদের রেল হাসপাতালে অক্সিজেন, নেবুলাইজার দিয়ে তরুণ ডাক্তার নীরজ সিংহকে বাঁচানোর চেষ্টা চালাচ্ছিলেন চিকিৎসকেরা। সদ্যবিবাহিত নীরজের স্ত্রী অনুমিতাও চিকিৎসক। অগ্নিকাণ্ডে মারা গিয়েছেন তিনি। ধানবাদের হাসপাতালের চিকিৎসক এস কে শর্মা বললেন, “ছেলেটা ভাল করে কথা বলতে পারছে না। তবু বারবার জানতে চাইছে, স্ত্রী কেমন আছে। ওকে কী জবাব দিই বলুন তো?” বৈষ্ণবঘাটা-পাটুলির বৃদ্ধ দম্পতি উষা ও বিষ্ণুরাম নাগরের বাড়ি তালাবন্ধ। বারাণসীতে বড় মেয়ের কাছে যাচ্ছিলেন তাঁরা। উষাদেবীর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে দুর্ঘটনাস্থলে রওনা হয়ে গিয়েছেন তাঁদের ছোট মেয়ে দিশা। বিষ্ণুরাম কোথায় আছেন, জানতে পারেননি পড়শিরা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.