‘অন্তর্ঘাতের’ কথাও রেলমন্ত্রীর মুখে
কর্তারা বলছেন শর্ট সার্কিট, কিন্তু কী করে
প্রথম দিনের অধিবেশন মুলতুবি হওয়ার পরে লোকসভা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী। হঠাৎই দাঁড়িয়ে গেলেন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীর সামনে!
তৃণমূল-সূত্র বলছে, মঙ্গলবার দীনেশের কাছে দুন এক্সপ্রেসে অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছেন সনিয়া। রেলমন্ত্রী তাঁকে নিজের মতো ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে এই ঘটনায় একটা বিষয় পরিষ্কার। তা হল: রেলের যাত্রী-সুরক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণের মান নিয়ে সব স্তরেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। উদ্বেগও তাই সর্বত্র।
প্রাথমিক তদন্তে রেল-কর্তারা বিপর্যয়ের পিছনে ‘বৈদ্যুতিক গোলযোগের’ হাত দেখেছেন। কোন যন্ত্র থেকে ওই গোলযোগ?
এ সম্পর্কে ‘সরকারি ভাবে’ কোনও তথ্য তাঁরা দেননি। উল্লেখ্য, গত এপ্রিলে মুম্বই-দিল্লি রাজধানী এক্সপ্রেসে শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন লেগেছিল। অ্যাটেন্ড্যান্টের তৎপরতায় তা দ্রুত নিভিয়ে ফেলা গিয়েছিল। কিন্তু দুন-দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে বাতানুকুল কামরার (বি-১ কোচের) অ্যাটেন্ড্যান্টের ভূমিকা নিয়েই উঠে গিয়েছে প্রশ্ন।
পুড়ে যাওয়া কামরা থাকে বার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেহ। মঙ্গলবার শৈলেন সরকারের তোলা ছবি।
রেল-সূত্রের খবর: বাতানুকূল যন্ত্র থাকে কামরার ছাদের নীচে। আর কন্ট্রোল প্যানেল বোর্ড থাকে কামরার যে কোনও দরজার পাশে। লোহার পাতে তৈরি প্যানেলটি দেখতে আলমারি মতো। সামনের দিকটা কাচের, ফলে বাইরে থেকে দেখা যায়, কোন কোন সুইচ দেওয়া রয়েছে। সেখানেই থাকে তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্র বা মিটার। মিটার দেখে মালুম হয়, কামরা কতটা ঠান্ডা হয়েছে। মিটারের রিডিং অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট রেলকর্মী কামরার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করেন।
দুন এক্সপ্রেসে অগ্নিকাণ্ডের ‘ধরন’ দেখে রেলের ইঞ্জিনিয়ারদের অনুমান, শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন ছড়িয়েছে বাতানুকূল যন্ত্রের আশপাশ, অর্থাৎ ছাদের ভিতর থেকেই। রেলের বৈদ্যুতিক বিভাগের ইঞ্জিনিয়ারদের কথায়, ওই এসি যন্ত্রে হিটারও থাকে। প্রচণ্ড শীতের সময়ে যা চালিয়ে কামরার ভিতরটা গরম রাখা হয়। হিটারের সঙ্গে থাকা ব্লোয়ার (পাখা)-এর মাধ্যমে কামরার মধ্যে গরম হাওয়া ছড়িয়ে পড়ে।
দুর্ঘটনার পরে প্রাথমিক ভাবে রেল-কর্তারা সম্ভাব্য দু’টো কারণের কথা বলেছেন। কী কী?
প্রথম সম্ভাবনা: এসি কামরায় (বি১) ঠান্ডা বেড়ে যাওয়ায় অ্যাটেন্ড্যান্টকে হিটার চালাতে বলেছিলেন যাত্রীরা। অ্যাটেন্ড্যান্ট ব্লোয়ার না-চালিয়েই হিটার পূর্ণমাত্রায় চালু করেন এবং ঘুমিয়ে পড়েন। ক্রমশ হিটার গরম হয়ে তা থেকে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট হয়ে থাকতে পারে। যদিও রেল মন্ত্রকের এক সূত্রের বক্তব্য, সাধারণত হিটারে অটো-কাট অর্থাৎ ‘থার্মোস্ট্যাট’ যন্ত্র থাকে। যার দরুণ অতিরিক্ত তপ্ত হয়ে উঠলে হিটার আপনা-আপনিই বন্ধ হয়ে যায়।
এ ক্ষেত্রে কি হিটারের থার্মোস্ট্যাট ঠিকঠাক কাজ করেনি? আরও গুরুতর প্রশ্ন, হিটার অন থাকা সত্ত্বেও অ্যাটেন্ড্যান্ট কেন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?
কোনও উত্তর এখনও মেলেনি। পাশাপাশি উঠে আসছে সম্ভাব্য দ্বিতীয় কারণ। রেলমন্ত্রকের একাংশের দাবি: রাতে ঠান্ডা লাগায় কোনও যাত্রী অ্যাটন্ড্যান্টকে না-পেয়ে নিজেই হিটার চালিয়ে দিয়েছিলেন। সেটাই বিপর্যয় ডেকে এনেছে। বস্তুত দগ্ধ কামরার একাধিক যাত্রীর মুখেও শোনা গিয়েছে এমন ভাষ্য।
কিন্তু এখানেও উঠে আসছে কিছু প্রশ্ন। যেমন, প্রতিটা এসি কামরায় বাথরুমের সামনে রাখা এসি-প্যানেল তালাবন্ধ থাকার কথা। সাধারণ কোনও যাত্রী তাতে হাত দেবেন কী ভাবে? এ প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রকের ব্যাখ্যা, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য মাঝে মাঝে প্যানেল খুলতে হয়। বারবার খোলা-বন্ধ করতে হয় বলে সব সময় তালা লাগানো হয় না। অ্যাটেন্ড্যান্টই প্যানেলের সামনে পাহারা দেন। অর্থাৎ, দ্বিতীয় সম্ভাবনার ক্ষেত্রে ধরে নিতে হচ্ছে, অ্যাটেন্ড্যান্ট প্যানেলের ধারে-কাছে ছিলেন না। তাই এ ক্ষেত্রেও গাফিলতির তির তাঁরই দিকে।
রেল-কর্তারা বৈদ্যুতিক বিভ্রাটের এমন সব ব্যাখ্যা দিলেও রেলমন্ত্রী অবশ্য দুর্ঘটনার পিছনে দুষ্কৃতীদের হাত থাকার সম্ভাবনাও উল্লেখ করেছেন। তাঁর কথায় “এক যাত্রী বয়ান দিয়েছেন, তিনি দুর্ঘটনার ঠিক আগে কোনও যাত্রীকে একটা ব্যাগ রাখতে দেখেছিলেন। যা থেকে পোড়া গন্ধ ও ধোঁয়া বার হচ্ছিল। তার পরেই আগুন দেখা যায়। ব্যক্তিটির খোঁজ পেতে ওই যাত্রীকে বিশদে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন তদন্তকারীরা।” রেল-সূত্রের খবর: ১৯৯০-এ মুম্বই মেলের এক কামরায় আগুন লেগে ২৭ যাত্রীর মৃত্যু হয়েছিল। যার তদন্তে তদানীন্তন রেলমন্ত্রী জাফর শরিফ কমিটি গড়েছিলেন। প্রতি কামরায় সেন্সার বসানো, চালক-গার্ড-অ্যাটেন্ড্যান্ট যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন কিংবা অগ্নি নিরোধক কামরা চালু করার মতো বেশ ক’টা সুপারিশও করেছিল কমিটি। কিন্তু তার অধিকাংশই মানা হয়নি বলে অভিযোগ রেলের প্রাক্তন স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ও সিপিএম সাংসদ বাসুদেব আচারিয়ার। তিনি বলেন, “রেলের কাজকর্ম এখন সম্পূর্ণ দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে চলছে। দু’-এক বছরের মধ্যে বড় বড় এতগুলো দুর্ঘটনা সেটাই প্রমাণ করে।” বাসুদেববাবুর আরও মন্তব্য, “রেলমন্ত্রী দিল্লিতে থাকেন না। বেশির ভাগ সময়ে কলকাতায়। কিছুই দেখছেন না। ডামাডোল চলছে!” সিপিএমের এক নেতার কথায়, “দুর্ঘটনার ক’ঘণ্টার মধ্যেই যদি রেলমন্ত্রী অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনা প্রকাশ্যে ভাসিয়ে দেন, তা হলে তার প্রভাব তদন্তে পড়তে বাধ্য।” সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, “রেলের যে হাল খারাপ হয়ে গিয়েছে, তা ফের প্রমাণিত।” দুন-দুর্ঘটনার কারণ যা-ই হোক, এতে রেলের যাত্রী-সুরক্ষা সম্পর্কে মন্ত্রকের ভূমিকা ফের প্রশ্নের মুখে পড়েছে। মন্ত্রক সারা দিনে সাড়ে বারো হাজার ট্রেন চালায়। সব মিলিয়ে লক্ষাধিকের বেশি কামরা রোজ রক্ষণাবেক্ষণ বা মেরামতি করা যে সম্ভব নয়, রেল-কর্তারাও তা বিলক্ষণ জানেন। রেল-কর্তাদের একাংশেরই বক্তব্য: বহু ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিয়েও ট্রেন চালাতে তাঁরা বাধ্য হন। রেলে নিরাপত্তা সংক্রান্ত রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সাধারণত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের হাতে। অথচ গত এপ্রিল পর্যন্ত চতুর্থ শ্রেণির প্রায় ১ লক্ষ ২৬ হাজার এবং তৃতীয় শ্রেণির ৩১ হাজার পদ খালি! যাত্রী-সুরক্ষার সঙ্গে জড়িত এত পদ ফাঁকা থাকলে যাত্রীরা আদৌ সুরক্ষিত থাকবেন কী করে, সে প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে রেল-প্রশাসনের অন্দরে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.