রাত আড়াইটে। দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা দেরাদুনমুখী ‘দুন এক্সপ্রেস’ পারসনাথ ও নিমিয়াঘাট স্টেশনের মাঝে।
হঠাৎই বাতানুকূল বি১ কামরার কিছু যাত্রীর নাকে এল তীব্র পোড়া গন্ধ। ধড়মড়িয়ে উঠে তাঁরা দেখলেন, চারপাশ ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছে। পরমুহূর্তে বোঝা গেল, কামরায় আগুন লেগেছে! আগুনের লেলিহান শিখা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে পাশের (বি২) কামরাতেও।
হাওড়া থেকে ছাড়া ট্রেনটির ঘুম-ভাঙা যাত্রীদের আর্তনাদ, বিভ্রান্ত ছোটাছুটির মধ্যে এক জন অবশ্য বুদ্ধি করে চেন টেনেছিলেন। ট্রেন থামতেই যাঁরা পারেন, কোনও মতে নেমে পড়েন জ্বলন্ত কামরা ছেড়ে। কিন্তু তার মধ্যেই পুড়ে মৃত্যু হয়েছে দু’টি শিশু-সহ মোট ৭ যাত্রীর। মৃতের তালিকায় আছেন এক অস্ট্রেলীয় তরুণীও। দগ্ধ চার যাত্রী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাঁদের এক জনের অবস্থা সঙ্কটজনক। |
ঝাড়খণ্ডে সোমবার রাতের এই দুর্ঘটনার পরে তদন্তে নেমে রেল-কর্তারা প্রাথমিক ভাবে মনে করছেন, ট্রেনের বৈদ্যুতিক লাইনে ‘শর্ট সার্কিট’-এর ফলেই এই বিপর্যয়। রেলের ধানবাদ ডিভিশনের অফিসারেরা জানাচ্ছেন, আগুনের উৎপত্তি বি১ কামরার শৌচাগারের কাছে। ধানবাদের ডিআরএম সুধীরকুমার বলেন, “পুড়ে-যাওয়া কামরা দু’টো পরীক্ষা করে দুর্ঘটনার কারণ খুঁজবেন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা।” রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী নিজে অবশ্য ‘অন্তর্ঘাতের’ সম্ভাবনাও মাথায় রাখছেন। মঙ্গলবার তিনি দিল্লিতে বলেন, “দুন এক্সপ্রেসে আগুন নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলছেন। এমনও শুনছি যে, এক যাত্রী একটা কিছু জিনিস রেখে চলে গিয়েছিলেন। তার পরেই পোড়া গন্ধ ছড়াতে শুরু করে। তদন্তে সব খুঁটিয়ে দেখা হবে।” মৃতদের পরিবারপিছু পাঁচ লক্ষ টাকা, ও আহতদের জন্য ২৫ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছেন রেলমন্ত্রী।
ঘটনাটি গভীর রাতে ঘটলেও ‘মাওবাদী-প্রভাবিত’ ওই তল্লাটে উদ্ধারকারী দল নিয়ে পৌঁছাতে রেল-কর্তাদের মঙ্গলবার সকাল গড়িয়ে যায়। পাহাড়-ঘেরা নির্জন প্রান্তরে খোলা আকাশের নীচে শীতের রাত কাটান দগ্ধ দুই কামরার যাত্রীরা। জখম যাত্রীদের চল্লিশ কিলোমিটার দূরে ধানবাদের রেল-হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল যখন, তখন ছ’ঘণ্টা কেটে গিয়েছে।
দুন এক্সপ্রেসের ভস্মীভূত কামরা দু’টোকে গোমো স্টেশনে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সকাল ন’টা নাগাদ, তার পরেই ওই লাইনে রেল চলাচল স্বাভাবিক হয় বলে জানান কর্তারা। তদন্তের স্বার্থে সে দু’টো ‘সিল’ করে দেওয়া হয়েছে। বাকি ট্রেনটি পারসনাথ স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে ফের দেরদুনের উদ্দেশে রওনা হয়ে যায় দুন এক্সপ্রেস। সামান্য জখম যাত্রীদের এ দিন বিকেলে আনা হয় হাওড়া স্টেশনে। সেখানে আহতদের হাতে নগদ ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ তুলে দেন রেল-কর্তারা। |
এ দিন বেলা বারোটা নাগাদ গোমো স্টেশনে পৌঁছে দেখা গেল, নিজের চার বছরের মেয়ে অর্চিতার দলা পাকানো ছোট্ট দেহের সামনে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে অন্নুদেবী কুমার। আত্মীয়ের বিয়ে উপলক্ষে আসানসোলের ওই গৃহবধূ মেয়েকে নিয়ে লখনউ যাচ্ছিলেন। আগুন লাগার পরে উদভ্রান্ত ঠেলাঠেলির চোটে অন্নুদেবী কামরা থেকে পড়ে যান। তার পরে আর ভিড় ঠেলে মেয়ের কাছে ফিরতে পারেননি। জ্বলন্ত ট্রেনে ঝলসে মারা যায় অর্চিতা। রেল-সূত্রে খবর: হরিদ্বারের কাছে কর্মরত সেনাবাহিনীর নায়েক মহম্মদ আকমন আলির বড় মেয়ে, আট বছরের মেহজুবি আলিও পুড়ে মারা গিয়েছে। মালদহের রতুয়ার বাসিন্দা আকমন ব্যান্ডেল থেকে ট্রেনে ওঠেন স্ত্রী আর দু’মেয়েকে নিয়ে।
বি১ কামরায় ছিলেন চার অস্ট্রেলীয় তরুণী। গবেষণার কাজে বেশ ক’মাস যাবত তাঁরা ভারতে। গবেষণারই কাজে বুদ্ধগয়া যাওয়ার জন্য সোমবার তাঁরা দুন এক্সপ্রেসে উঠেছিলেন। রেলের খবর: ওঁদের মধ্যে এমিলি রোজ নামে এক তরুণী পুড়ে মারা গিয়েছেন, গুরুতর দগ্ধ তাঁর সঙ্গিনী প্রোনিয়ান। তাঁকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় বোকারোর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গ্বালিয়রের তরুণ ডাক্তার-দম্পতি নীরজ ও অনুমিতা সিংহ ছিলেন বি১ কামরায়। অনুমিতা পুড়ে মারা গিয়েছেন। নীরজ ধানবাদের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। |
একটি বিয়ে উপলক্ষ্যে প্রৌঢ় ভাইপো চুন্নিলালকে নিয়ে বারাণসী যাচ্ছিলেন পঁচাত্তরের বৃদ্ধ হাসানন্দ ক্ষেত্রী। শারীরিক প্রতিবন্ধী চুন্নিলাল জ্বলন্ত কামরা থেকে নামতে পারেননি। গোমোয় পৌঁছে কলকাতার নিউ আলিপুরের বাসিন্দা হাসানন্দ বলেন, “রাতে ঘুম ভাঙার পরে বাথরুমে গিয়েছিলাম। বেরোতেই দেখি, গোটা কামরা ধোঁয়ায় ভরে উঠেছে। নেমে আসা ছাড়া উপায় ছিল না।” সকালের আগে রেল-কর্তাদের দেখা মেলেনি বলেও অভিযোগ করেন বৃদ্ধ। অগ্নিকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে নানা যাত্রীর নানা মত। কারও কারও দাবি, বি১-এ পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে একটা জোরালো আওয়াজ শুনেছিলেন। কারও কারও অবশ্য ধারণা, কোনও যাত্রীই ট্রেনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র নাড়াচাড়া করায় বিভ্রাট ঘটে থাকতে পারে। যার প্রেক্ষিতে এসি কামরায় ‘অ্যাটেন্ড্যান্ট’ না-থাকা নিয়ে তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন। যেমন, বি১-এর যাত্রী বিজয়কুমারের কথায়, “ট্রেন ছাড়ার সময়ে অ্যাটেন্ড্যান্ট ছিলেন। পরে এসি-র ঠান্ডা কমানোর জন্য তাঁকে ডাকাডাকি করলেও খোঁজ মেলেনি।” ওই অবস্থায় যাত্রীদেরই কেউ এসি মেশিনের ‘নব’ ঘুরিয়ে ঠান্ডা কমানোর চেষ্টা করেছিলেন বলে জানিয়েছেন অনেকে। |