সোমবার রাতের বিমানে কলকাতায় পা রেখে মঙ্গলবার দুপুরেই রাজ্য সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বসলেন চাঙ্গি এয়ারপোর্টস ইন্টারন্যাশনাল (সিএআই)-এর শীর্ষ কর্তারা। এবং সেই আলোচনার পর শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সাংবাদিকদের জানালেন, অন্ডাল বিমাননগরী প্রকল্পের অন্যতম অংশীদার ওই সংস্থাকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে সরকারের তরফে। সিঙ্গাপুরের সংস্থাটির কর্তাদের তিনি বলেছেন, “আগে বিমানবন্দর গড়ে সরকারের আস্থা জিতুন আপনারা। সেই সঙ্গে স্থানীয় মানুষেরও।”
রাজ্যের শিল্পমন্ত্রীর এই মন্তব্য থেকে অনেকেই মনে করছেন, বিমাননগরী প্রকল্পটি নিয়ে নির্মাণকারী সংস্থার প্রতি কোথাও একটা অনাস্থা রয়েছে রাজ্য সরকারের। সে কারণেই তাদের আগে বিমানবন্দরের কাজ ‘শেষ করে দেখাতে’ বলা হয়েছে। যদিও প্রত্যাশিত ভাবেই এ নিয়ে বিশদে মুখ খোলেননি দু’পক্ষ। তবে বৈঠকের পরে সংস্থার তরফে দাবি করা হয়েছে, প্রকল্প ঘিরে দু’পক্ষের মধ্যে যে অবিশ্বাসের মেঘ জমেছিল, তা অনেকটাই কেটে গিয়েছে। চাঙ্গি সংস্থার চিফ এগ্জিকিউটিভ অফিসার (সিইও) লিম লিয়াং সং-ও বৈঠকের পরে বাইরে এসে বলেন, “বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে।” |
চাঙ্গি এয়ারপোর্টসের সিইও লিম লিয়াং সং-এর সঙ্গে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র |
এ দিনের আলোচনায় যোগ দিতে সোমবার রাতেই সিঙ্গাপুর থেকে শহরে এসে পৌঁছন চাঙ্গি এয়ারপোর্টসের সিইও লিম লিয়াং সং এবং ডেপুটি সিইও ইউজেন গান। দুপুরে পার্থবাবুর সঙ্গে বৈঠকে তাঁদের সঙ্গেই উপস্থিত ছিলেন অন্ডাল বিমাননগরী প্রকল্পের নির্মাতা সংস্থা বেঙ্গল এরোট্রোপলিস লিমিটেড (বিএপিএল)-এর ডিরেক্টর পার্থ ঘোষ এবং সিইও সুব্রত পাল। উল্টো দিকে, শিল্পমন্ত্রী ছাড়াও রাজ্য সরকারের তরফে আলোচনায় অংশ নেন শিল্পসচিব দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায় এবং রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর নন্দিনী চক্রবর্তী। প্রকল্পটি নিয়ে এখনও বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে বলে মেনে নিয়েছে দু’পক্ষই। সমস্যা মেটাতে রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম একটি কোর কমিটি গঠন করেছে। পাশাপাশি বিএপিএল-এর কাছ থেকে কিছু তথ্যও চাওয়া হয়েছে। সুব্রতবাবুর কথায়, “লিম সদ্য দায়িত্ব নিয়েছেন। তাই প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন।”
রাজ্যের নতুন সরকারের ‘উদাসীন’ মনোভাব দেখে প্রকল্পটির ভবিষ্যত নিয়ে সংশয়ে ছিলেন চাঙ্গি কর্তৃপক্ষ। সে কারণে রাজ্যের শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসতেও চাইছিলেন তাঁরা। দীর্ঘদিন ধরে দু’পক্ষের মধ্যে কথাবার্তার পরে অবশেষে মঙ্গলবার সেই বৈঠক হল। সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, প্রকল্প নিয়ে রাজ্য সরকারের মনোভাব বুঝতেই শহরে পা রেখেছিলেন চাঙ্গি কর্তারা। কারণ, বিমাননগরী প্রকল্পে ২৬ শতাংশ অংশীদারি রয়েছে চাঙ্গির। শুধু তাই নয়, সিঙ্গাপুরের বাইরে এটিই তাদের প্রথম লগ্নি। যে কারণে এই প্রকল্পের সাফল্য ভবিষ্যতে অন্যান্য জায়গাতেও তুলে ধরতে চায় তারা। তাই অনেকের মতে, নিজেদের এই ‘শো-কেস’ প্রকল্প নিয়ে সরকারের মনোভাব বুঝে নিতে নিয়ে চেয়েছিল চাঙ্গি। একেবারে গোড়া থেকেই প্রায় প্রতি পদে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে এই বিমাননগরী প্রকল্প। পূর্বতন বাম সরকারের জমানায় জমি অধিগ্রহণের সময় প্রথমে তৈরি হয় জটিলতা। প্রকল্প এলাকার কিছু অংশে মাটির নীচে কয়লা থাকার যুক্তিতে আপত্তি তোলে কোল ইন্ডিয়াও। পরে কয়লা মন্ত্রকের হস্তক্ষেপে সেই সমস্যা মেটে।
রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পর ফের বাধার মুখে পড়ে এই প্রকল্প। প্রথমে তৃণমূল কংগ্রেসের পতাকার তলায় জমির জন্য আরও বেশি ক্ষতিপূরণ চেয়ে শুরু হয় আন্দোলন। জটিলতা সৃষ্টি হয় বাকি জমি পাওয়া নিয়েও। এখনও পর্যন্ত প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ২,১৬০ একর জমির মধ্যে ১,৮১৮ একরই হাতে পেয়ে গিয়েছে বিএপিএল। সংস্থার অভিযোগ, বাকি ১৯২ একর জমি অধিগ্রহণ হয়ে গেলেও জমি মালিকদের কাছে ‘চেক’ বিলি করেননি জেলা প্রশাসন। এ দিনের বৈঠকে প্রসঙ্গটি উঠলে শিল্পমন্ত্রী জানিয়ে দেন, যে জমি হাতে আছে, আগে তাই দিয়েই কাজ এগোক চাঙ্গি। বিমানবন্দর গড়ার কাজ শেষ করে তার পরে অন্য কাজ শুরু করুক তারা। পরে বাইরে এসে সাংবাদিকদের সামনেও শিল্পমন্ত্রীর বলেন, “বিমানবন্দরের জন্য ৬৫০ একর জমি দরকার। কিন্তু ওঁদের হাতে জমি রয়েছে তার থেকেও অনেক বেশি। বিমানবন্দরই আগে গড়তে হবে। কারণ, রাজ্য সরকারের আস্থা বাড়াতে তা জরুরি।”
রাজ্যে সরকার গড়ার পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, বেসরকারি শিল্পের জন্য তাঁর সরকার জমি অধিগ্রহণ করবে না। শিল্পমন্ত্রীও এ দিন বৈঠকে সে কথা ফের জানিয়ে দেন। তাই বাকি ১৯২ একর জমি কী ভাবে হাতে আসবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। প্রকল্প এলাকা থেকে একটি হাই টেনশন বিদ্যুতের লাইন সরানোর জন্য আগের সরকার ৫০ কোটি টাকা ঋণ দেবে বলেছিল। এ দিনের বৈঠকে সেই টাকার কথা উঠলে রাজ্য জানায়, সরকারের অর্থাভাবের কথা।
তবে চাঙ্গির কাছে অন্যতম বড় সমস্যা ছিল তাদের প্রতি রাজ্য সরকারের অনাস্থার মনোভাব। এ দিনের বৈঠকের পরে তা দূর হয়েছে বলে দাবি সংস্থার। প্রথমে ঠিক হয়েছিল, বিমানবন্দরের পাশাপাশি প্রকল্প এলাকায় একই সঙ্গে আবাসন, শিল্প তালুক, বাণিজ্যিক পরিকাঠামো ইত্যাদি গড়বে বিএপিএল। ব্যবসায়িক ভাবে লাভজনক করে তুলতে একটি সার্বিক প্রকল্প (ইন্টিগ্রেটেড প্রোজেক্ট) হিসেবে গড়ে উঠবে অন্ডাল বিমাননগরী। চাঙ্গি-কর্তারা আশ্বাস দিয়েছেন, আগামী অক্টোবর-নভেম্বরেই বিমানবন্দর চালু করা হবে। এ দিন রাজ্য স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, ওই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিমানবন্দর গড়ে আগে সরকারের আস্থা জিতুক সংস্থাটি। তবে বাকি জমিতে উপনগরী তৈরির কাজেও কোনও বাধা নেই বলে মনে করেন বিএপিএল-এর কর্তারা।
জমি-জটের জেরে প্রথমে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পেতেও সমস্যায় পড়েছিল বিএপিএল। তাই অর্থ জোগাড়ের জন্য ২০০ একর জমি বন্ধক রেখে নিগমের কাছ থেকে ৩৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল তারা। সুদ-সহ সেই ঋণের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার পর প্রায় ছ’মাস কেটে গেলেও এখনও সেই জমি ফেরত পায়নি বিএপিএল। তবে তা শীঘ্রই পেয়ে যাবেন বলে আশাবাদী সংস্থা-কর্তারা। |