সোমবার সকাল ৮টা। অশোকনগর স্টেশনে ঢুকল ভিড়ে ঠাসা ট্রেনটি। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, আসলে এটা মহিলা ‘স্পেশ্যাল’ ট্রেন। ভর্তি কামরার দরজার দু’পাশে দাঁড়িয়ে কিছু যুবক। ঠেলাঠেলি করে উঠতে না-পেরে চিৎকার করছেন মহিলারা। যুবকেরা নির্বিকার।
কেন উঠছেন মহিলাদের ট্রেনে?
এক-এক জনের এক-এক রকম ‘যুক্তি’। এবং বেশির ভাগ ‘যুক্তি’ই বড় বিচিত্র!
• “কীসের মহিলা-ট্রেন? তা হলে পুরুষ চালক, পুরুষ গার্ড রয়েছেন কেন? মহিলাদেরই ট্রেনটা চালাতে বলুন না!” ঝেঁঝে উঠে বললেন এক যুবক।
• “অফিসের ব্যস্ত সময়ে ওঁরা এ ভাবে হাত-পা ছড়িয়ে যাবেন কেন? আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি!” ওই যুবকের পাশে দাঁড়ানো মাঝবয়সী ব্যক্তিটির গলায় ঝাঁঝ আরও বেশি।
• “পুলিশ আমাদের ধরলে ওরা হাসে, হাততালি দেয়। পাড়ার এক মহিলা তো আমার ধরা পড়ার গল্প সাতকাহন করে বলে দিয়েছে আমার বৌকে! বলল কেন? একটু শান্তিতে যাওয়া সহ্য হচ্ছে না!” রোগাপাতলা চেহারার এক জনের যত রাগ মহিলা যাত্রীদের উপরেই।
শনিবার এই সব যুক্তিতেই মহিলা-ট্রেন আটকে রেখেছিলেন তাঁরা। ভোগান্তির চরম সীমায় পৌঁছে তাই ছাতা, জলের বোতল নিয়ে তাড়া করে অবরোধকারীদের তুলে দিয়েছিলেন বনগাঁ মাতৃভূমি লোকালের মহিলারা। সঙ্গে ছিল পুলিশও। |
মহিলা-ট্রেনে ছেলেদের ভিড়। সোমবার। ছবি: পার্থসারথি নন্দী |
তাতেও অবশ্য বিন্দুমাত্র লজ্জিত হননি ওই পুরুষ যাত্রীরা। সোমবারেও ওই মহিলা-ট্রেনের চিত্র এতটুকু পাল্টায়নি। সকাল ৭টা ১২ মিনিটে ডাউন বনগাঁ-শিয়ালদহ মাতৃভূমি স্পেশ্যালটি গোবরডাঙা ছাড়তেই পুরুষদের ভিড়ে ভরে যায়। এমএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী টুইঙ্কিল দাঁ বলেন, “দেখার কেউ নেই। সব স্টেশন থেকেই পুরুষেরা ওঠে। এমনকী নেশা করে গায়ে ঢলেও পড়ে। নেমে যেতে বললে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। এ ভাবেই রোজ যাতায়াত করতে হয়।” সাড়ে ৮টায় বারাসতে পৌঁছয় ট্রেনটি। দু’পাশের ভেন্ডার কামরা দখল করে বসে আছেন পুরুষেরা। অন্য কামরার ভিতরে তো বটেই, দরজার কাছেও ভিড় পুরুষদের। তাঁদের ঠেলে মহিলারা উঠতেও পারছেন না।
শিয়ালদহ মেন শাখায় আপ ও ডাউন মিলিয়ে চারটি মহিলা-ট্রেন চলে। রানাঘাট ও কৃষ্ণনগর লোকাল। একই চিত্র ওই ট্রেনগুলিরও। ব্যারাকপুরে ট্রেন দু’টি ঢুকতেই দেখা দেল, প্রতিটি কামরায় উঠে পড়েছেন পুরুষেরা। মহিলাদের অভিযোগ, কৃষ্ণনগর ও রানাঘাট থেকে নৈহাটি পর্যন্ত স্টেশনে ও ট্রেনে কোনও পুলিশ থাকে না। নৈহাটি থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত মাত্র তিন জন আরপিএফ মহিলা কনস্টেবল এবং এক জন পুরুষ অফিসার ট্রেনে থাকেন। তাতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। মহিলাদের অভিযোগ, নির্দিষ্ট কিছু পুরুষই প্রতিদিন এই ট্রেনে ওঠেন। কেউ কেউ অসভ্যতাও করেন। প্রতিবাদ করায় ৫ মার্চ দমদম স্টেশনে মহিলাদের মারধরও করা হয়। একাধিক অভিযোগ করা হয়েছে দমদম ও শিয়ালদহ রেল পুলিশের কাছে।
শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার বারুইপুর মহিলা স্পেশ্যালেরও একই অবস্থা। বারুইপুর স্টেশনে দেখা গেল, ট্রেনের পিছন ও সামনের কামরায় উঠেছে যুবকেরা। মহিলারা গুটিসুটি মেরে উঠছেন মাঝখানের কামরাগুলিতে। বারুইপুরের দাসপাড়ার বাসিন্দা, নিত্যযাত্রী এক ছাত্রী বলেন, “পিছনের কামরায় ছেলেরা নানা ভাবে বিরক্ত করে। তাই মাঝখানের কামরায় উঠি।
মহিলা-ট্রেনে পুরুষেরা উঠলে কী সাজা হতে পারে? রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, মহিলা-ট্রেনে পুরুষেরা উঠলে তাদের ধরে জিআরপি-তে দেওয়া হয়। জিআরপি আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেয়। আর পুলিশি সূত্রের খবর, ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা জরিমানা হতে পারে। দিতে না-পারলে ধৃত পুরুষ যাত্রীকে আদালতে তোলা হয়।
কিন্তু ধরা পড়লে তবে তো জরিমানা করা হবে বা আদালতে তোলা হবে? আইন ভঙ্গকারীদের ধরার মতো পুলিশ কোথায় মহিলা-ট্রেনে? এ ব্যাপারে কী বলছে পুলিশ?
বিশ্বনাথ যাদব নামে মহিলা-ট্রেনে প্রহরারত এক পুলিশ অফিসার বলেন, “একটি ট্রেনের জন্য বরাদ্দ চার জন পুলিশ। তা দিয়ে ৩৬টি দরজা পাহারা দেওয়া অসম্ভব। কয়েক দিন আগেই বিধাননগর স্টেশনে মহিলা-ট্রেনে ওঠার সময় কয়েক জন যুবককে বাধা দেওয়া হয়েছিল। এক মহিলা কনস্টেবলকে ঘুষি মেরে জখম করে চার যুবক।” শিয়ালদহের রেল পুলিশ সুপার তাপসরঞ্জন ঘোষ অবশ্য বলেন, “নিয়ম করে প্রতিদিনই স্টেশনে পাহারা এবং মহিলা-ট্রেনে পুলিশ থাকে। ধরপাকড়ও চলছে।”
কিন্তু কি বনগাঁ লাইন আর কি শিয়ালদহ মেন বা দক্ষিণ সেই ‘পুলিশি তৎপরতা’র আঁচ সোমবার তেমন পাওয়া গেল কই! |