নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর থেকে রাজনৈতিক শিবিরে বহুচর্চিত বিষয়টি এ বার ‘আনুষ্ঠানিক’ ভাবে স্বীকার করে নিল সিপিএম। ‘শ্রমিক শ্রেণির দল’ হিসাবে পরিচিত সিপিএম মেনে নিল, শ্রমিক ফ্রন্টে ‘যোগ্য নেতৃত্বে’র অভাব দেখা দিয়েছে। তবে সিপিএমেরই একাংশের মতে, নেতৃত্বের এই সঙ্কট শুধু শ্রমিক সংগঠনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। বিভিন্ন গণ সংগঠন এবং সার্বিক ভাবে দলের বিভিন্ন স্তরেই এই সমস্যা এখন সিপিএমকে ভোগাচ্ছে। সেই অর্থে ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্বের প্রশ্নে যে স্বীকারোক্তি দলের নথিতে স্থান পেয়েছে, তা আসলে বৃহত্তর ক্ষেত্রে ‘বাস্তবতা’রই উল্লেখ।
নেতৃত্বের সঙ্কট সম্পর্কে সিপিএমের ‘স্বীকারোক্তি’ রয়েছে দলের রাজ্য কমিটির তরফে সর্ব শেষ পার্টি চিঠিতে। সেখানে পুরনো নেতৃত্বের সরে যাওয়া এবং নতুন নেতৃত্বের উঠে আসার মাঝে ব্যবধানের কথা বলা হয়েছে ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষেত্রে। পার্টি চিঠিতে বলা হয়েছে: ‘সংগঠিত ক্ষেত্রে বহু শিল্পে ও কারখানায় বহু সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে আমাদের ইউনিয়নগুলি গড়ে উঠেছিল ও শক্তিশালী হয়েছিল। পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তর দশকের সেই যোগ্য নেতৃত্বের মধ্যে অনেকেই আজ প্রয়াত অথবা বয়সের ভারে অশক্ত, তাঁদের স্থান পূরণ করার মতো যোগ্য নেতৃত্ব অনেক ক্ষেত্রেই গড়ে তোলা যায়নি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে নতুন নেতৃত্ব নিজেদের যথাযথ ভাবে গ্রহণযোগ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি’।
সদ্যপ্রকাশিত ৪ নম্বর পার্টি চিঠির বিষয়বস্তুই হল ‘ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্টে আমাদের কাজ’। সেই কারণেই শ্রমিক নেতৃত্বের বিষয়টি সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু ‘বয়সের ভারে অশক্ত’ নেতাদের বিভিন্ন কমিটির শীর্ষে কেন বসিয়ে রাখা হয়েছে বা বাম জমানায় অসুস্থ মন্ত্রীরা কেন পদ থেকে অব্যাহতি পাননি, সেই প্রশ্ন বারেবারেই দলের ভিতরে-বাইরে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে, তিন বারের বেশি কোনও স্তরের কমিটিতেই কেউ সম্পাদক হতে পারবেন না। সেই ‘নিয়ম’ অবশ্য কার্যকর হবে পার্টি কংগ্রেসে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়ে দলের গঠনতন্ত্র সংশোধিত হওয়ার পরেই।
কিন্তু প্রবীণ নেতৃত্ব সরে গিয়ে নতুন মুখ আনার প্রক্রিয়ায় রাতারাতি নেতাদের ‘গ্রহণযোগ্যতা’র সমস্যা যে মিটে যাবে না, সেই ‘বাস্তবতা’র ইঙ্গিতই এ বারের পার্টি চিঠিতে ধরা পড়েছে বলে দলের একাংশের অভিমত। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, “এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রবীণরা সরে যাবেন। নতুনরা তাঁদের জায়গা নেবেন। কে কোথায় উঠে আসবেন, এটা নির্দিষ্ট করে আগাম বলা সম্ভব নয়! লেনিনবাদী-স্তালিনবাদী সংগঠনে আন্দোলনের স্তর পেরিয়েই স্বাভাবিক ভাবে নেতৃত্ব তৈরি হয়।”
কিন্তু ‘স্বাভাবিক’ ভাবে যে নেতৃত্ব উঠে আসছেন না, তা-ও মেনে নেওয়া হয়েছে পার্টি চিঠিতেই। বলা হয়েছে, ‘কোথাও কোথাও ট্রেড ইউনিয়ন গণতান্ত্রিক ভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। গণতান্ত্রিক ভাবে ইউনিয়ন পরিচালনা সংগঠিত ও অসংগঠিত উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু এই নীতি ঠিক ভাবে পালন না-করার ফলে শিল্প বা কারখানায় এর প্রতিকূল প্রভাব পড়ছে’। সম্মেলন-পর্বে রাজ্য নেতৃত্ব দলের জন্য যে রূপরেখা বেঁধে দিয়েছে, অনেকটা সেই সুরেই ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষেত্রেও বলা হয়েছে: ‘কোনও কোনও ক্ষেত্রে ব্যক্তির অতি প্রাধান্য নতুন কমরেডদের গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। ব্যক্তিপ্রাধান্য তৈরির চেষ্টা বা ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষা করার ঝোঁক থাকার ফলে অনেক ক্ষেত্রে ইউনিয়নের মধ্যে গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। পার্টির গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব অনেক কারখানায় প্রকট হয়ে সংগঠনের ক্ষতি করেছে। পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে কর্মীদের সঙ্গে আচরণ যথেষ্ট ক্ষতি করেছে’। সংগঠন পরিচালনায় ‘গণতান্ত্রিক’ পদ্ধতির ঘাটতি কবুলের পাশাপাশিই উল্লেখ করা হয়েছে, ‘দলাদলি’র জেরে শিল্প-নেতৃত্বের একটি অংশ ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ হয়ে পড়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
বস্তুত, অসংগঠিত শিল্পের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দল তথা শ্রমিক সংগঠন যে তার ফায়দা নিতে পারেনি, তা এখন বুঝতে পারছে সিপিএম। কলকাতা, ব্যারাকপুর, হাওড়া, হুগলি শিল্পাঞ্চলে সংগঠিত ও অসংগঠিত দুই ক্ষেত্রেই পুরভোট এবং বিধানসভা ভোটে সিপিএম যে ভাবে সমর্থন পায়নি, তার প্রেক্ষিতে সংগঠনের ‘দুর্বলতা’ মেনে নেওয়া হয়েছে দলের অন্দরে সাম্প্রতিকতম দলিলে। রাজ্যে ভূমি সংস্কার জনিত ‘আর্থিক সাফল্যের পথ বেয়ে’ এবং নতুন ধরনের বাজার ও কর্মসংস্থান তৈরি হওয়ার ফলে গ্রামেও এখন অসংগঠিত শ্রমিকের সংখ্যা বহু গুণ বেড়েছে। পার্টি চিঠির তথ্য অনুযায়ীই, রাজ্যের গ্রামীণ এলাকায় শ্রমিকের সংখ্যা আনুমানিক ১ কোটি ৮০ লক্ষ। তার মধ্যে গত কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করেও ১৩-১৪ লক্ষের বেশি শ্রমিককে নিজেদের সংগঠনের দিকে টেনে আনতে পারেনি সিপিএম।
বিপর্যয়ের পরে কেন্দ্রীয় কমিটির পর্যালোচনা সূত্র ধরেই নিজেদের শ্রেণি সমর্থনের ভিত্তি নিয়ে এখন নতুন করে ভাবছে সিপিএম। উদারনীতির ফলে সৃষ্ট নতুন এক মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের (যারা তুলনায় ‘স্বচ্ছল’) উপরে বামেদের ‘রাজনৈতিক প্রভাব’ তৈরি হয়নি। আবার মধ্যবিত্তেরই যে অংশটি আর্থিক আক্রমণের জেরে আরও ‘নীচের দিকে’ নেমে গিয়েছে, তাদের সঙ্গে ‘রাজনৈতিক যোগাযোগ’ও বাড়ানো যায়নি। অসংগঠিত শিল্পের পাশাপাশিই জনসমাজের এই অংশগুলির সঙ্গে যোগাযোগ পুনঃস্থাপনের চেষ্টায় আছে সিপিএম।
কিন্তু ‘যোগ্য নেতৃত্ব’ ছাড়া সেই চেষ্টায় সাফল্য আসবে কি? প্রশ্ন থাকছে দলেই! |