|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
রাজ্যে দশটি জেলায় মেডিক্যাল কলেজ চাই |
হাসপাতালে অব্যবস্থা রোজ শিরোনামে। স্বেচ্ছা-অবসর চাইছেন জেলা হাসপাতালের
সিনিয়র ডাক্তাররা, আর এম ও পদে নিযুক্ত তরুণ ডাক্তাররা যোগ দিচ্ছেন না।
কী করে ফিরবে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল? মত জানালেন
ডা. দেবী শেঠি |
|
|
ভারতে স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য বরাদ্দ জাতীয় উৎপাদনের মাত্র এক শতাংশ। সরকারি হাসপাতালের জন্য যে সামান্য টাকা বরাদ্দ, আর তার উপর যে চাপ তৈরি হয়েছে, তাতে তার পক্ষে ভাল পরিষেবা দেওয়া সম্ভব নয়। যে হাসপাতালে দু’শো লোকের চিকিৎসা হওয়ার কথা, সেখানে দু’হাজার লোক এলে তা ভেঙে পড়বেই, সেখানকার ডাক্তার ও ম্যানেজমেন্ট যতই ভাল হোক। কেন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, তা নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা হয়েছে, এ বার দরকার সমাধানের চিন্তা করা। যা এখনই করা যায়, আর যা করতে একটু সময় লাগবে, দুটোই ভাবতে হবে।
যা এখনই করা যায়, তা হল গরিবের জন্য এমন স্বাস্থ্য বিমার ব্যবস্থা করা, যাতে তার সামনে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর সুযোগও তৈরি হয়। কর্ণাটকে যশস্বিনী বিমা প্রকল্প চলছে আট বছর, এখন ৪০ লক্ষ কৃষক তার সদস্য, প্রত্যেকে মাসে ১০ টাকা দিচ্ছেন। সরকারের ভূমিকা কেবল re-insurer। বিমার নেটওয়ার্কে রয়েছে চারশোটি হাসপাতাল। তেমনই অন্ধ্রপ্রদেশে চলছে ‘আরোগ্যশ্রী’ প্রকল্প, তামিলনাড়ুতে কালাইনার প্রকল্প। এগুলো যত ভাল চলা দরকার ততটাই চলছে, এমন বলা চলে না। কিন্তু গরিব বলেই কেবল সরকারি হাসপাতালে যেতে হচ্ছে না। যেমন গর্ভবতী মায়ের মৃত্যু, শিশু মৃত্যু এড়ানোর উপায় হিসেবে গুজরাতে গর্ভবতীদের হাতে একটা ‘ভাউচার’ দেওয়া হচ্ছে। যেখানেই প্রসব হোক, সরকারি বা বেসরকারি, হাসপাতাল ওই ভাউচার জমা দিয়ে টাকা পেয়ে যাবে। খুব টাকা খরচ না করেই এগুলো এখনই করা যায়।
আর তা করা দরকার, কারণ এ দেশে প্রয়োজনের নিরিখে হাসপাতাল শয্যা ৩০ লক্ষ কম, ডাক্তার ১০ লক্ষ কম। কেবল সরকারের পক্ষে যে এত শয্যা, এত ডাক্তারের ব্যবস্থা সম্ভব নয়, তা বুঝতে হবে। বিমা প্রকল্প শুরু হলে বেসরকারি পরিষেবার সুযোগ নেওয়ার মতো মানুষ বাড়বে, প্রাইভেট হাসপাতালও বাড়বে। মান নিয়ে একটা প্রশ্ন তো থাকবেই, নজরদারির ব্যবস্থাও চাই। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে চিকিৎসার পরিণাম দেখেও মানের একটা আন্দাজ করা চলে, যেমন সন্তান প্রসবের পর শিশু, মা কেমন আছে। গরিবের জন্য স্বাস্থ্য বিমা তাই এখনই শুরু করা দরকার।
আর একটু দূরের দিকে তাকিয়ে যা করা দরকার, তা হল আরও অনেক মেডিক্যাল কলেজ শুরু করা। ডাক্তারের ঘাটতি মেটাতে ভারতে এখনই ৫০০ মেডিক্যাল কলেজ চাই। পশ্চিমবঙ্গে দশটি জেলা হাসপাতালের সঙ্গে দশটি কলেজ শুরু করা দরকার। এর ফলে জেলাগুলিতে চিকিৎসার অনেক উন্নতি হবে-- হাসপাতালগুলিতে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি তো থাকবেই, সেই সঙ্গে ডাক্তার, নার্স, ও অন্যান্য কর্মীদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। একটা জেলা হাসপাতালে কয়েকশো প্রশিক্ষণরত ডাক্তার ও নার্স বিনা পয়সায় পাওয়া যাবে। জেলা থেকে কলকাতায় রোগী আসা কমানো যাবে। রুগ্ণ শিশু নিয়ে বি সি রায় হাসপাতালে মায়েরা লাইন দিয়েছেন, এই দৃশ্য বদলানোর এটাই উপায়।
|
|
সরকার কলেজ চালাবে কী করে, সেই প্রশ্ন উঠবে। কিন্তু তা খুব অসম্ভব নয়। এখন ব্যাঙ্কগুলি চার লক্ষ টাকা পর্যন্ত শিক্ষাঋণ দেয়, কোনও জামানত ছাড়াই। মেডিক্যাল কলেজে যে ছাত্ররা ভর্তি হবে, তারা সকলেই ঋণ পেতে পারে। কোনও ক্যাপিটেশন ফি না নিলেও, ফি হিসেবে সেই টাকা সরকার নিতে পারে। পাশ করার পর ডাক্তারদের পক্ষে ওই টাকা শোধ দেওয়া খুব কঠিন হবে, এমন ভাবার কারণ নেই।
মেডিক্যাল কলেজ কিন্তু সরকারকেই চালাতে হবে। বেসরকারি সংস্থার কাছে মেডিক্যাল কলেজ চালানোর খরচ খুব বেশি, কারণ তাদের হাসপাতালও তৈরি করতে হয়। ছাত্রদের ফি নিয়ে হাসপাতাল চালাতে হয়, কারণ রোগী কম থাকে। যেখানে হাসপাতাল লাভজনক হয়, যেমন ক্রিশ্চিয়ান মেডিক্যাল কলেজ ভেলোর, সেখানে ছাত্রদের ফি খুব সামান্যই। সেখানে হাসপাতালের টাকায় কলেজ চলে। কিন্তু অধিকাংশ বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ক্যাপিটেশন ফি নেয়। যে কোনও দেশে দেখা যায়, অসামান্য চিকিৎসকরা এসেছেন দরিদ্র পরিবার থেকে। তাঁদেরই মনে সেই জেদের আগুন রয়েছে, যার জন্য তাঁরা দিনে ২০ ঘন্টা পরিশ্রম করে হার্ট সার্জারি বা নিউরো সার্জারি করেন। এই ছেলেমেয়েরা কিন্তু বেসরকারি হাসপাতাল থেকে বাদ পড়ে যাবে, কারণ সেখানে পড়ার খরচ কম করা প্রায় অসম্ভব। তাই সরকার যদি বাড়তি ডাক্তার তৈরি করার জন্য বেসরকারি সংস্থাকে বিনা পয়সায় জমি দেয় বা কর মকুব করে, তা ভুল নীতি হবে। মেডিক্যাল কলেজ, নার্সিং কলেজ তৈরি করে ডাক্তার-নার্স তৈরি করতে হবে সরকারকেই।
পশ্চিমবঙ্গে এই প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি। কেন মালায়লি নার্সরা চালায় এ রাজ্যের হাসপাতাল? কেন কর্ণাটকের ডাক্তারদের উপর নির্ভর করতে হয় এ রাজ্যের রোগীদের? সর্বত্রই ডাক্তার-নার্সের ঘাটতি। অন্য রাজ্যের উপর নির্ভরতা চালিয়ে গেলে তার জন্য খেসারতের পরিমাণ ক্রমশ বাড়বে। এখন থেকে কলেজের সংখ্যা বাড়ালে চাহিদা এবং জোগানের সমতা আসবে। বাড়বে রোগীর জন্য শয্যাও। কর্ণাটকে ৪০টি মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে, সেখান থেকে পাশ-করা ডাক্তাররা বেশির ভাগ রাজ্যেই থেকে যান। অনেকেই অল্প কিছু বেডের একটি নার্সিংহোম, বা একটা ছোট হাসপাতাল খোলেন। এ ভাবে জনসংখ্যা অনুপাতে শয্যা অনেক বাড়ে, সরকারি হাসপাতালের উপর চাপ কমে।
সর্বোপরি, প্রশিক্ষিত ডাক্তারের সংখ্যা বাড়বে। চিকিৎসায় আমরা বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলি বিল্ডিং কিংবা মেশিনকে। আমার কাছে যত হার্টের রোগী আসেন, তাঁদের ৯৫ শতাংশকে আমি গাছতলায় বসে দেখতে পারি। পাঁচ শতাংশের সি টি স্ক্যান, এম আর আই দরকার হয়। আসল প্রয়োজন ডাক্তার। এখন মেডিক্যাল পড়া শেষ করার পর প্রায় ৩০ শতাংশ ছাত্র ডাক্তারি না করে আই এ এস, সফটওয়্যার বা ব্যাঙ্কিং-এর মতো কাজে চলে যাচ্ছে। তাই প্রয়োজনের তুলনায় কিছু বেশি ডাক্তার তৈরি করতে হবে।
|
কী করা উচিত |
গর্ভবতীদের ভাউচার দেওয়া। যে হালপাতালে প্রসব হোক, ওই ভাউচার জমা দিলে টাকা পাওয়া যাবে। |
|
কী করা উচিত নয় |
জেলায় মেডিক্যাল কলেজ না করে কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলোকে আরও উন্নত করা। তাতে শহরে আরও ভিড় বাড়বে, স্বাস্থ্য পরিষেবা ভেঙে পড়বে। |
|
ডাক্তাররা জেলায় পড়াতে চাইবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এখানেও নিয়মের কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন— পুরো সময়ের শিক্ষক ছাড়া কেউ পড়াতে পারবেন না, এবং সেই শিক্ষককেও ৬০ বছরে অবসর নিতেই হবে, ভারত ছাড়া আর কোথাও এই নিয়ম নেই। জেলায় ভাল সার্জন অনেক আছেন, তাঁদের আংশিক সময় পড়ানোর সুযোগ করে দিতে হবে। তা ছাড়া এখন প্রযুক্তি এত উন্নত যে সব পরিষেবার জন্য বিশেষজ্ঞদের জেলাতেই যেতে হবে, এমন তো নয়। বেঙ্গালুরুতে বসে রেডিয়োলজিস্টরা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, সিঙ্গাপুরের সি টি স্ক্যান, এম আর আই পড়ে দিচ্ছেন, কলকাতায় বসে জেলার ছবি কেন পড়া যাবে না? ইন্টারনেটের জন্য তাতে তো খরচও নেই।
জেলায় মেডিক্যাল কলেজ না করে যদি কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলোতে আরও দামি মেশিন, আরও ভাল ডাক্তার নিয়োগ করা হয়, ফল হবে উলটো। আরও বেশি রোগী ভিড় করবে কলকাতায়, স্বাস্থ্য পরিষেবা ভেঙে পড়বে। প্রয়োজন জেলাগুলিকে উন্নত করা। তার উপায় জেলা হাসপাতালের সঙ্গে মেডিক্যাল কলেজ তৈরি করা।
|
সাক্ষাৎকার: স্বাতী ভট্টাচার্য |
|
|
|
|
|