এক তীব্র কিন্তু নীরব দুর্ভিক্ষ যেন ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যে’ শীর্ষক নিবন্ধে (২৯-৯) স্বাতী ভট্টাচার্য শিশুদের অপুষ্টির যে কারণগুলি তুলে ধরেছেন, তার সবগুলি যে যথার্থ নয়, সেই সত্যই উঠে এসেছে একই দিনে। ‘কারণ ওগুলো খাবারের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি’ শীর্ষক অমিতাভ গুপ্তর নিবন্ধে। এই সম্পর্কে আমাদের বিদ্যালয় ও গ্রামের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে চাই।
শিশু-অপুষ্টির হার যেমন বাড়ছে, তেমনই কিশোর-কিশোরীদের মধ্যেও অপুষ্টির হার বাড়ছে। বিদ্যালয়ে প্রতিদিন প্রার্থনাসভা চলাকালীন একাধিক ছাত্র, বিশেষত ছাত্রী দুর্বলতার কারণে মাথা ঘুরে টলে পড়ে। সামান্য কষ্ট করার ক্ষমতাও অনেকে হারিয়ে ফেলছে। আমাদের অনুসন্ধানে যে-কারণগুলি উঠে আসে, তা দারিদ্র। খাদ্য-নিরাপত্তার অভাব, খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি প্রভৃতিগুলি গৌণ। বিদ্যালয়ে দুর্বল শরীর, রুগ্ণ শরীর এবং অপুষ্টি নিয়ে যে-সব ছেলেমেয়ে আসে, তারা বেশির ভাগই দরিদ্র পরিবারের নয়। শিশু বয়স থেকে ভুল খাদ্যাভ্যাস, সময় মেনে না-খাওয়া এগুলিও অপুষ্টির কারণ। গ্রামের অভিভাবকদের এ বিষয়ে সচেতনতার খুবই অভাব। |
অপুষ্ট। বীরভূমের নানুর এলাকার একটি শিশু। |
আমরা জানতে পারি যে, স্কুলে আসার সময় বাড়ির কাজ ছেড়ে ছেলেমেয়েদের জন্য ভাত রান্না করেন না বহু মা। ফলে, চিনি ও জল সহযোগে মুড়ি খেয়ে স্কুলে আসতে বাধ্য হয়। অনেকে সেটুকুও না-খেয়ে খালিপেটে আসে সকালের প্রাইভেট টিউশন পড়ে বাড়ি ফিরে আর খাওয়ার সময় থাকে না বলে। অভিভাবকদের সভায় ৯০ শতাংশ অভিভাবকই বলেন, তাঁর ছেলে বা মেয়েটি কিছুই খেতে চায় না। শাক-সবজি খাবার প্রচুর বিচার। দেখা যায়, এদের কেউ-ই ছেলেমেয়েদের শরীরচর্চার কথা ভাবেন না। বিদ্যালয়ে যোগাসন যেগুলি শেখানো হয়, বাড়িতে তার চর্চা করে না। স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার প্রচণ্ড অভাব আর কু-খাদ্যাভ্যাসই অপুষ্টির জন্য অনেকটা দায়ী। পুষ্টি, সুস্বাস্থ্য নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার রসদ কোথায়? ভোরবেলা রাস্তার ধারে খোলা আকাশের নীচে ঘাসের আগায় কানে মোবাইল নিয়ে প্রাতঃকৃত্য করতে দেখা যাবেই। যে-কোনও ‘নির্মল গ্রাম পঞ্চায়েত’ এলাকায় গরিব পরিবারে কালার টিভি, ডিভিডি আছে। অথচ প্রাতঃকৃত্য করে মাঠে। গরিব খেতমজুরপাড়ায় ধুম করে বিভিন্ন পূজা-পার্বন পালন করা দেখলে অবাক হয়ে যাই। অথচ এই পাড়ার ছেলেমেয়েরাই অপুষ্টি ও নানা অসুখে ভোগে যথাযথ খাদ্যের অভাবে। সুতরাং মানুষের সচেতনতার মাত্রার উপরও অপুষ্টি অনেকটা নির্ভর করে। দারিদ্র বা আর্থিক সঙ্কট নেই এমনটা বলা যাচ্ছে না, কিন্তু বাস্তব তথ্য তুলে না আনলে সরকার ও নাগরিক সকলকেই বিভ্রান্ত করা হবে।
সন্দীপ সিংহ। প্রধান শিক্ষক, জামাইবাটি উচ্চ বিদ্যালয়, হরিপাল, হুগলি
লেখকের সংযোজন: সন্দীপবাবুকে ধন্যবাদ, তিনি এই জরুরি কথাটি তুলে ধরেছেন যে, দারিদ্রই অপুষ্টির একমাত্র কারণ নয়। শিক্ষা দফতরের সমীক্ষা অনুসারে অপুষ্টি যেখানে ৮৮ শতাংশের, সেখানে কেবল দরিদ্র পরিবারের শিশুরাই অপুষ্ট নয়, তা ধরেই নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু অপুষ্টির কতখানি দারিদ্রের কারণে, আর কতখানি ‘সচেতনতার’ অভাবে, তা নির্ধারণ করা যাবে কী করে? এক-এক জনের অভিজ্ঞতায়, অবলোকনে এক-এক রকম উত্তর মিলবে।
খাদ্য-নিরাপত্তার অভাব অপুষ্টির কারণ হিসেবে ‘গৌণ’ কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া সহজ নয়। শিশু-অপুষ্টি নিবারণের নীতি খাদ্য-নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেবে, না কি ‘সচেতনতা’ তৈরি করাকে আগে রাখবে, সেই বিতর্ক চলতে থাকবে, যদি না এ রাজ্যে শিশুর অপুষ্টির কারণ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সমীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।
তবু এই প্রবন্ধে যে দারিদ্রকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, তার কারণ এই পরিসংখ্যান যে, অপুষ্ট শিশুদের অর্ধেকেরও বেশি অত্যন্ত অপুষ্ট। বাড়িতে যথেষ্ট খাবার রয়েছে, অথচ শিশু দিনের পর দিন এত কম খাবার খাচ্ছে যে, তার ওজন-দৈর্ঘ্য স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম রয়ে যাচ্ছে, এ কথা মেনে নেওয়া কঠিন। কেবল পেট ভরে খেলেই শিশুর ওজন স্বাভাবিক থাকার কথা। বাবা-মা খাদ্যের পুষ্টিগুণ বিষয়ে যদি সচেতন না-ও হন, সন্তানকে পেট ভরে খাওয়ানোর ইচ্ছে বা সময় তাঁদের নেই, এটা এত সহজে ধরে নেওয়া চলে না।
অমিতাভ গুপ্ত যে-বইটি অবলম্বন করে তাঁর নিবন্ধ লিখেছেন, সেই ‘পুয়োর ইকনমিক্স’ বইটির লেখক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এসথার ডুফলো যে গরিব মানুষকে তাঁর দুর্দশার জন্য দোষারোপ করেছেন, এমন নয়। তাঁরা বলতে চেয়েছেন, যাঁরা গরিব মানুষদের জন্য নীতি তৈরি করেন, গরিব মানুষের পছন্দ-অপছন্দ, আশা-আশঙ্কার খোঁজ তাঁরা রাখেন না। যেমন দেখা যাচ্ছে, চাল-গমে ভর্তুকি দিলে যে টাকা বাঁচে, তা আরও চাল-গম কেনার জন্য খরচ না করে গরিব পরিবার অন্য কাজে ব্যবহার করে। যেমন আরও সুস্বাদু খাবার কেনা, কিংবা বিনোদন। এই ঝোঁক দেখা যাচ্ছে বিশ্বের সব দেশেই। তাই লেখকদের মত, চাল-গম সস্তায় দেওয়া অপুষ্টি কমানোর উপযুক্ত নীতি নয়। বাবা-মা শিশুর পুষ্টির বিষয়ে উদাসীন, এ কথা তাঁরা বলেননি। নীতি যদি ঠিক হয়, তবে ওই সব পরিবারেই শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করার শর্তগুলি পূরণ করা যাবে।
|
কেদার-বদ্রীও ট্রেনে যেতে হবে? |
সহজ হবে কেদার-বদ্রী যাত্রা’ (১০-১১) খবরে আনন্দের চেয়ে আতঙ্কই হল বেশি। হৃষীকেশ-কর্ণপ্রয়াগ রেলপথের শিলান্যাসের সৌজন্যে আগামী দিনে কেদার-বদ্রী-সহ গাড়োয়ালের অন্যান্য স্থানের যাত্রা সুগম করবে রেল। ১২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথে মোট ১২টি স্টেশন থাকবে। ট্রেন যাবে হরিদ্বার থেকে হৃষীকেশ হয়ে রুদ্রপ্রয়াগ ছুঁয়ে কর্ণপ্রয়াগ। ফলে, সড়কপথের চেয়ে রেলপথে দূরত্ব কমবে ৫১ কিলোমিটার। এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যটকদের ভিড়ে সরগরম থাকে এই পাহাড়ি পথ। বাকি চার মাস বরফে ঢাকা থাকে এই পথের একাংশ। শিবালিক পাহাড়ের এই পথকে ঘিরেই প্রস্তাবিত রেলপথের শিলান্যাস হল গৌচরে। ৫৮ নং জাতীয় সড়কের সমান্তরাল কিছুটা যাবে এই রেলপথ। তার পর নদী পেরিয়ে শ্রীনগর-রুদ্রপ্রয়াগ ছুঁয়ে কর্ণপ্রয়াগ পৌঁছবে। অনেক জায়গাতেই রেলপথ এলিভেটেড হবে কোথাও কোথাও সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে যাবে। উদ্দেশ্য একটাই, সড়কপথের প্রাকৃতিক বাধা-বিঘ্নকে অতিক্রম করে কর্ণপ্রয়াগ পর্যন্ত পর্যটকদের যাতায়াত নিশ্চিত করা। ফলে, কোপ পড়তে চলেছে শিবালিকের প্রকৃতিতে। বিশেষ করে, গাড়োয়াল হিমালয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এর ফলে বিপন্ন হবে, তা বোঝার জন্য পরিবেশবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই। |
এমনিতেই বিস্তৃত হিমালয়ের তুষাররাজ্য আজ বিপর্যয়ের মুখে। দূষণ আর উষ্ণায়নের প্রকোপে গলতে শুরু করেছে গঙ্গোত্রীর বরফ। স্থানচ্যুতি ঘটছে গঙ্গার উৎসমুখের। অমরনাথের পবিত্র শিবলিঙ্গও আজ সঙ্কটের মুখে। এই অবস্থায় কেদার-বদ্রী সংলগ্ন পার্বত্য অঞ্চল ধ্বংস করে সেখানে ট্রেন চালানোর পর্যটনমুখী পরিকল্পনা আত্মঘাতী। টানেল নির্মাণ-সহ বিশাল কর্মযজ্ঞের সময় ধস নামার মতো দুর্ঘটনার পাশাপাশি আছে ভূমিকম্পের আশঙ্কাও। যোগ হবে ১২টি স্টেশন তথা জনপথের বাড়তি চাপ। প্রশ্ন জাগে, তথাকথিত সভ্যতার আগ্রাসনে কেদার-বদ্রীর সহজ পথের রেলযাত্রা অদূর ভবিষ্যতে এক স্থানীয় বিপর্যয় ডেকে আনবে না তো?
অরুণকুমার চক্রবর্তী। কলকাতা-৬৩ |