এই ঘটনা মর্মান্তিক, সন্দেহ নেই, কিন্তু সব দায় কি চাপানো যায়
চিকিৎসকদের উপরে? চিকিৎসা-পরিকাঠামোর দশা খুবই করুণ।
ভাঙচুর করলেই সমস্যার সমাধান আসবে? উত্তর খুঁজলেন অরিজিতা দত্ত |
পশ্চিমবঙ্গ ভারতের এমন একটি রাজ্য যেখানে শিশুমৃত্যুর হার যথেষ্ট কম এবং একই সঙ্গে পূর্ণ টীকাপ্রাপ্ত শিশুর হারও ভারতের সামগ্রিক হারের তুলনায় বেশি। অথচ সাম্প্রতিক কালে সংবাদমাধ্যমে এসেছে পর পর কয়েকটি ঘটনা। একই দিনে একই সরকারি হাসপাতালে ১০-১২টি শিশুর মৃত্যু। প্রথমে দু’বার কলকাতার বি সি রায় শিশু হাসপাতালে এবং আরও সাম্প্রতিক কালে মালদহ জেলা হাসপাতালে। স্বাস্থ্য অধিকর্তারা দৃশ্যত অস্বস্তিতে। আর, মানুষ আরও একবার দেখেছেন সরকারি হাসপাতালের অব্যবস্থা এবং চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীর ঔদাসীন্য। প্রথম দুটি ঘটনার বিভাগীয় তদন্তে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট কর্মীদের দায়মুক্ত করা হয়েছে, যাতে ভিতরে ভিতরে বিরক্তই হয়েছেন আমজনতা।
শিশুমৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক নিশ্চয়ই, কিন্তু সত্যিই কি সব দায় চাপিয়ে দেওয়া যায় চিকিৎসকের গাফিলতির উপর? আর তার সঙ্গে পথ অবরোধ করে, চিকিৎসককে মারধর করে সেই গাফিলতির প্রতিশোধ নেওয়া যায়?
|
ভারতের অধিকাংশ শিশুর মৃত্যু হয় প্রধানত সংক্রামক (জল ও বায়ুবাহিত) রোগে। পরজীবী আক্রমণ সংক্রান্ত টীকা দ্বারা প্রতিরোধযোগ্য রোগে বা অপুষ্টির কারণে। সে ক্ষেত্রে শিশুস্বাস্থ্যের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে কর্মরতা অক্সিলিয়ারি নার্স মিড ওয়াইফদের (ANM) গুরুত্ব অপরিসীম। ২০১০ সালে প্রকাশিত গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার নিরিখে প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মধ্যে আছে মাত্র ৪৮ শতাংশ, উপকেন্দ্র আছে ৮৬ শতাংশ। মোট ৯০৯টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মধ্যে একটিতেও রেফারেলের যানবাহনের ব্যবস্থা নেই। আর ইন্ডিয়ান পাবলিক হেলথ স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী সামগ্রিক পরিকাঠামোও একটিতেও নেই। সারা পশ্চিমবঙ্গে সদ্যোজাত শিশুর চিকিৎসার জন্য সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট (SNCU) আছে মাত্র সাতটি। যার একটিও মালদহ বা মুর্শিবাদের মতো জেলায় নেই। গুজরাত ও তামিলনাড়ুর SNCU-এর সংখ্যা যথাক্রমে ৪৩ ও ২৫।
|
জনসংখ্যাভিত্তিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এএনএম পশ্চিমবঙ্গে আছে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি। অথচ ১৫১টি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে এখনও কোনও এএনএম নেই। অর্থাৎ এই স্বাস্থ্যকর্মীদের সব কেন্দ্রে সমান ভাবে নিযুক্ত করা যায়নি। আবার, সমস্ত স্বাস্থ্য উপকেন্দ্রের সঙ্গে এএনএম-এর কোয়ার্টার আছে মাত্র ২৩.৬ শতাংশ আর তার মধ্যে আবার মাত্র ২.১ শতাংশে এএনএম-রা থাকেন (সর্বভারতীয় নিরিখে এই পরিসংখ্যান ৬২ শতাংশ)! ফলে, দূরত্বের কারণে অনেক ধাত্রীই সঠিক পরিষেবা দিতে পারে না। এবং মা শিশুকে টীকা দেওয়াতে নিয়ে গিয়ে ফিরে আসেন। |
এতে সঠিক সময়ে সঠিক টীকাটি পড়ে না। বাড়ে টীকা-সূচের সংখ্যা ও বেঠিক সময়ে কিন্তু সব ক’টি আবশ্যিক টীকাপ্রাপ্ত শিশুর সংখ্যা। এই সবের জন্য শিশুর রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতা কমে। এবং সে সহজে নানান সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়।
|
২০১০ সালের তথ্য অনুযায়ী এ রাজ্যে ব্লক প্রাইমারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ২৭১ জন অনুমোদিত শিশুচিকিৎসকের পদে মাত্র ৫৯টিতে ডাক্তার আছেন। যার অর্থ, শূন্যস্থান ৭৮ শতাংশ। শূন্যস্থানের এই পরিসংখ্যান ভারতের মধ্যে দ্বিতীয়। সর্বাধিক শূন্যস্থান আছে ছত্তীসগঢ়ে। আবার মোট জনসংখ্যাভিত্তিক প্রয়োজনের তুলনায় এ রাজ্যে শিশুচিকিৎসক মাত্র ১৭ শতাংশে।
শুধু তাই নয়, আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতেও প্রচুর পদ ফাঁকা। এ বার তার উপরের জেলা মহকুমা ও স্টেট জেনারেল হাসপাতালগুলি সঙ্গে নিলে পঞ্চান্ন হাজার শিশুর জন্য একজন সরকারি শিশুচিকিৎসক পাওয়া যায়। তাই বোঝাই যায় যে, এই শিশুচিকিৎসকদের উপর চাপ কী ভয়ঙ্কর। দ্বিস্তর হাসপাতালগুলি ধরলে চাপ সর্বাধিক মালদহ জেলায়, তার পরই মুর্শিদাবাদে। এর সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য পরিষেবার অপ্রতুলতা। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে যে এই দ্বিস্তর হাসপাতালগুলির বহির্বিভাগে দেখানোর পর মাত্র ১৭.৫ শতাংশ শিশু প্রেসক্রিপশনে লেখা সব অথবা প্রায়-সব ওষুধ পায়। বাকিটা কিনে নিতে হয় বাইরের দোকান থেকে। যার গড় খরচ দাঁড়ায় ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা। অর্থাৎ যে ক’জন শিশুচিকিৎসক জেলায় কাজ করেন, তাঁরা অনেকটাই ঢাল তরোয়ালহীন নিধিরাম সর্দারের মতো। পরিকাঠামো নেই, ওষুধ নেই, সঠিক চিকিৎসা দেওয়া হয়ে দাঁড়ায় প্রায় অসাধ্য।
শিশুচিকিৎসার এই ভয়ানক অপ্রতুলতার চিত্রটি স্পষ্ট হয় স্বাস্থ্য শিক্ষার অবস্থাটি দেখলে। শিশুচিকিৎসায় স্নাতকোত্তর স্তরে এ রাজ্যে আসন সংখ্যা ৪২ আর ২০১০ সালে পাশ করে বেরিয়েছে মাত্র নয় জন শিশুচিকিৎসক। এ প্রসঙ্গে এ-ও জানাই যে, এএনএম ট্রেনিংয়ের এক একটি স্কুল পশ্চিমবঙ্গের ৫৭.৫ লক্ষ গ্রামীণ জনগণের জন্য বরাদ্দ, যা সর্বভারতীয় স্তরে দ্বিতীয় সর্বাধিক। এর থেকে বোঝা যায় যে, শিশুচিকিৎসার উপযোগী মানবসম্পদ কেন এ রাজ্যে অপ্রতুল!
|
অবশেষে আসি রোগীর আত্মীয়স্বজনের প্রসঙ্গে। প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে, ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের ২০০৪-’০৫-এর তথ্য অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের ৬১ শতাংশ শিশুর ওজন উচ্চতার তুলনায় কম। ফলে, শিশুরা রোগের সঙ্গে লড়াই করতে পারে কম। সদ্যোজাত শিশুরা কম ওজনের হলে যে তৎক্ষণাৎ SNCU-এর প্রয়োজন, তা এ রাজ্যে কম। তাই একমাত্র উপায় থাকে মেডিক্যাল কলেজে দৌড়ে আসা। যেখানে ব্যবস্থা হয়তো আছে, কিন্তু প্রবল জনসংখ্যার চাপে সেই পরিষেবাও মুমূর্ষু।
সেখানে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক শোকের মধ্যেও আইন নিজের হাতে তুলে পরিকাঠামো ভাঙচুর করার আগে মনে রাখতে হবে যে, এই সবই আমাদের সকলের আর একে নতুন করে গড়ে তুলতে সময় ও অর্থ দুই-ই লাগে অনেক বেশি।
অন্য দিকে, স্বাস্থ্য অধিকর্তাদের বলতে চাইব যে, এই মানুষগুলিকে তাদের অভিযোগ জানানোর এবং সেই অভিযোগকে পরীক্ষা করে সংশ্লিষ্ট কর্মীকে শাস্তি দেওয়ার সঠিক ব্যবস্থা থাকলে তবেই এই জাতীয় ঘটনা এড়ানো যায়।
অন্যথায় রোগীর, বিশেষ করে শিশু-মৃত্যুর ফলে বিহ্বল আত্মীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করার একটিই মাত্র পথ দেখেন নৈরাজ্য। সেই মুহূর্তে একটু সহৃদয় ব্যবহার ও পরে সঠিক তদন্তের ব্যবস্থা থাকলে বোধহয় এই নৈরাজ্যের অবস্থার একটু পরিবর্তন হবে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক |