ভোররাত্রে একটি অস্বাভাবিক আওয়াজ। শীত-নিশীথের ঘুম না-ও ভাঙিতে পারিত। ভাঙিলেও শব্দের উৎসসন্ধানে ধাবিত হওয়া গড়পড়তা আচরণের নিরিখে আর এক অ-স্বাভাবিক কাজ। অথচ, বেণু প্রধান সেই কাজটি করিয়াছেন। পরিণামে, একটি ধাবমান দূরপাল্লার ট্রেন সম্ভাব্য একটি মারাত্মক দুর্ঘটনার গ্রাস হইতে রক্ষা পাইয়াছে। বেণু শুধুমাত্র শব্দ-সন্ধান করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই। তিনি অনুসন্ধানে গিয়া দেখিয়াছেন, লাইনে ফাটল। তৎক্ষণাৎ বাড়ি আসিয়া একটি শাড়ি তুলিয়া লইয়াছেন, সঙ্গে ছিল আলো। আলো-শাড়ির বিপদসঙ্কেত ট্রেনচালককে সজাগ করিয়াছে। ধাবমান ট্রেনটি ফাটলের সন্নিকটে আসিয়া থামিয়াছে। বেণু প্রধানের দাদাই কিছু দিন আগে এমন ভাবে অন্য একটি ট্রেনকে বিপদের কবল হইতে রক্ষা করিয়াছিলেন। এই দায়িত্বশীলতাকে সাধুবাদ জ্ঞাপন করা জরুরি।
নাগরিকের অধিকার লইয়া চতুর্দিকে বিবিধ প্রতর্ক, আলোচনা এবং দাবিদাওয়ার স্তূপ। নাগরিকের কী কী পাওয়া উচিত, কেন পাওয়া উচিত, সেই সব বিষয়ে অজস্র কথাবার্তা। অথচ, নাগরিকের কী কী করণীয়, সেই বিষয়টি লইয়া জনমন বিশেষ আলোড়িত নহে। অপ্রাপ্তির ক্ষোভ জনতাকে এমনই বিচলিত করিয়া রাখে যে, প্রায়শই নানাবিধ ক্ষোভের প্রকাশ ঘটে সরকারি সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের আইনবহির্ভূত কার্যে। যেন, কয়টি সরকারি গাড়ি বা ভবন ভাঙচুর করিলেই রাগ প্রশমিত হইবে, সরকার তড়িঘড়ি যাবতীয় দাবিসনদ মানিয়া লইবেন! জনতার ক্রোধ এমনই মারাত্মক হয় যে, সরকার যে তাঁহাদেরই দ্বারা নির্বাচিত, এবং সরকারি সম্পত্তিও জনতারই প্রদত্ত করের অর্থে ক্রীত, সেই জরুরি সত্যটিও বেমালুম ডুবিয়া যায়। সরকারের প্রতি, সরকারি সম্পত্তির প্রতি এবং নিজস্ব স্বার্থের গণ্ডির বাহিরে বৃহত্তর জনসমাজের প্রতি জনতার মনোভাব এই গভীর অর্থেই নেতিবাচক। বেণু প্রধান বা তাঁহার অগ্রজ ভানুভূষণ কোনও স্বার্থসিদ্ধির আশায় এই কাজ করেন নাই। রেললাইনে ফাটল ধরিয়াছে বটে, কিন্তু রেল সরকারের সম্পত্তি, সুতরাং যাহা হয় হউক, আমার কী, এই ভাবিয়া হাত গুটাইয়াও থাকেন নাই। তাঁহারা নিজস্ব দায়িত্ববোধের তাড়নায় স্বেচ্ছাশ্রমটি দিয়াছেন। পরিণামে, অজস্র প্রাণ রক্ষা পাইয়াছে। বেণু প্রধান এবং ভানুভূষণ সরকারি সম্পত্তি বা বেশ কিছু প্রাণ বাঁচাইয়াছেন। তাহার সহিত ব্যক্তি এবং সমাজের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়েও একটি মূল্যবান দিশা দেখাইয়াছেন। নাগরিকের দায়িত্ব কী হইতে পারে, তাহার একটি উজ্জ্বল নিদর্শন এই ঘটনা দুইটির ভিতর নিহিত। নাগরিকের অধিকারের সহিত নাগরিকের দায়িত্বও যে একটি পারস্পরিকতার সম্পর্কে অন্বিত, তাহা নানা সময় বলা হইয়া থাকে। অধিকারের সহিত দায়িত্বের সেই বাঞ্ছিত সমন্বয়টি জীবনে কার্যকর করিবার দৃষ্টান্ত বিরল। রাষ্ট্রকে প্রায়শই যন্ত্রের সহিত তুলনা করা হয় বটে, কিন্তু স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে সেই রাষ্ট্র-যন্ত্রটিও কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মানব সম্পদের উপর নির্ভরশীল। সেই মানব সম্পদের দায়িত্ববোধ নামক গুণটি না থাকিলে রাষ্ট্র-যন্ত্রের পক্ষেও নির্বিঘ্নে অগ্রসর হওয়া কঠিন। বেণু প্রধানের ন্যায় ব্যক্তি গভীরতর অর্থেই ‘সম্পদ’ বলিয়া গণ্য হইবার যোগ্য। তাঁহারা নিছকই একটি ট্রেনের সম্মুখে সতর্কবার্তা প্রেরণ করেন নাই। বার্তাটি সমাজের প্রতিও বটে। |