আরব বসন্তের জুঁই বিপ্লবের সৌরভ কি ম্রিয়মাণ হইতে শুরু করিয়াছে? টিউনিসিয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হইয়াছে ইসলামপন্থী এন্নাহ্দা পার্টি। আর মিশরে পার্লামেন্ট নির্বাচনের পূর্বাহ্ণে রাষ্ট্রশক্তির সহিত জনতার সংঘর্ষে রক্তাক্ত হইয়া উঠিয়াছে তাহ্রির স্কোয়ার, যেখানে প্রবল জনবিক্ষোভের চাপে প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারককে গদিচ্যুত হইতে হয়। তাহ্রির স্কোয়ারে বিক্ষোভের কারণ দ্বিবিধ। এক, সেনাবাহিনীর তরফে প্রচারিত খসড়া সংবিধানে অসামরিক সরকারকে প্রতিরক্ষা বাজেট ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের নজরদারির অধিকার না দেওয়া। দুই, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২০১২-র শেষ কিংবা তাহার পরের বছরের শুরু অবধি স্থগিত করার কর্মসূচি। বিক্ষোভকারীদের মতে, এই উভয় বন্দোবস্তই দেশের উপর সামরিক বাহিনীর আধিপত্য কায়েম করার অভিসন্ধিপ্রসূত। অথচ তাঁহারা তো মুবারকের স্বৈরতন্ত্রকে এ জন্য বিদায় করেন নাই যে, তাহার স্থলে সামরিক বাহিনীর স্বৈরাচার কায়েম হইবে? অতএব নির্বাচনের আগেই প্রতিবাদ, বিক্ষোভ। সেই বিক্ষোভ সংঘর্ষে পরিণত হইলে অন্তত ১৩ জনের মৃত্যু হইয়াছে, আহত হইয়াছেন অনেকে। স্বভাবতই মিশরে গণতন্ত্রের আবাহনের প্রক্রিয়াটি শান্তিপূর্ণ থাকিতেছে না।
সামরিক বাহিনী মিশরের সর্বাপেক্ষা সংগঠিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ শক্তি। এই বাহিনীর জোরেই হোসনি মুবারক তাঁহার স্বৈরাচার এত দীর্ঘ কাল চালাইতে পারিয়াছিলেন। তাঁহার অপসারণ ব্যক্তি স্বৈরাচারীর বিদায়ঘণ্টা বাজাইয়াছিল, প্রাতিষ্ঠানিক স্বৈরাচারকে উৎপাটিত করিতে পারে নাই। প্রথমাবধি জেনারেলরা বিদায়ী প্রেসিডেন্টের বিকল্প রূপে নিজেদের তুলিয়া ধরেন। গণজোয়ারের অভিঘাতে সে-সময় নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হইলেও মিশরের জেনারেলরা ক্ষমতার মঞ্চ হইতে সহসা অবসৃত হইতে প্রস্তুত নন। জেনারেলরা কবেই বা এবং কোথায়ই বা স্বেচ্ছায় জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলিয়া দিয়া বানপ্রস্থে গিয়াছেন? বরং দেশে দেশে উর্দিধারীদের দেখা গিয়াছে বিশ্বের নিকট গণতান্ত্রিক বৈধতা আদায় করার ব্যগ্রতায় উর্দি ছাড়িয়া প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হইতে এবং একতরফা, প্রতিদ্বন্দ্বীবর্জিত গণভোটে ৯৯ শতাংশ ভোটপ্রাপ্তির প্রহসন মঞ্চস্থ করিয়া ক্ষমতায় টিকিয়া যাইতে। মিশরের জেনারেলরা অন্য রকম ভাবিতেছেন, জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে মর্যাদা দিয়া নির্বাচিত অসামরিক জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত করিয়া সেনা-ছাউনিতে ফিরিবার জন্য প্রস্তুত হইতেছেন, এমন কোনও প্রমাণ এখনও মেলে নাই। তবে বিপরীত অভিপ্রায়ের প্রমাণ দাখিল হইয়া গিয়াছে। সেনাবাহিনীকে ভবিষ্যতের নির্বাচিত পার্লামেন্টের নজরদারির ঊর্ধ্বে স্থাপন করার সাংবিধানিক খসড়া তাহারই পরিচয়।
এত ক্ষয়ক্ষতি ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়া যে-মিশরবাসী মুবারকের একনায়কত্ব হইতে মুক্তি পাইয়াছেন, তাঁহাদের পক্ষে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার এই উল্টা রথের যাত্রা মানিয়া লওয়া সম্ভব নয়। স্বভাবতই তাঁহারা ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ, আক্রমণাত্মক। সেনাবাহিনী দেশবাসীর সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিতেছে, এমনই তাঁহাদের অভিযোগ। তাঁহাদের ক্রুদ্ধ সমাবেশে তাই রাষ্ট্রশক্তির গুলিবর্ষণ তাঁহাদের ক্ষোভকে তীব্রতর করিয়াছে। বিক্ষোভ কেবল রাজধানী কায়রোর তাহ্রির স্কোয়ারের নাগরিক জমায়েতেই সীমাবদ্ধ থাকে নাই, আলেকজান্দ্রিয়া, সুয়েজ, আসোয়ান প্রভৃতি প্রাদেশিক শহরেও সমান তীব্রতায় ছড়াইয়া পড়িতেছে। সেই বিক্ষোভকারীদের শিবিরে ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’-এর মতো ইসলামপন্থীদের সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবকদের সক্রিয় অংশগ্রহণের সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু সেই কারণে অসামরিক জনসাধারণের উপর হিংস্র দমননীতি নামাইবার কোনও নৈতিকতা অনির্বাচিত সামরিক পরিষদের থাকিতে পারে না। ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার অজুহাতে গণতন্ত্রকে খর্ব করিয়া স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার নজির আলজিরিয়া সহ ইসলামের ভুবনে একাধিক। মিশরের সেনাবাহিনীও কি সেই পথেই প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থার সুযোগ হইতে মিশরবাসীকে বঞ্চিত করিতে চায়? |