পাচুয়াড়ায় ঝাঁপ পড়েছে স্কুলেও
সিস্টার নেই, এখন ব্যান্ডেজ বেঁধে দেবে কে
প্রতিবাদী, জনদরদী, সমাজকর্মী। এলাকার অনেক মানুষের কাছে সিস্টার ওয়ালসার পরিচিতি ছিল এ রকমই। গত মঙ্গলবার রাতে এ হেন যে মহিলাকে কুপিয়ে-পিটিয়ে খুন করে গেল এক দল দুষ্কৃতী, তাঁর জীবনযাপনও ছিল নিতান্ত সাদামাটা।
মঙ্গলবার রাতে বাঁশের বেড়া-টালির ছাউনির ঘরে চৌকিতে শুয়েছিলেন আদতে কেরলের এর্নাকুলামের বাসিন্দা ওই খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনী। রাত এগারোটা নাগাদ আততায়ীরা হানা দেয়। ঘরের মধ্যেই মাথায় টাঙ্গির কোপ মেরে তাঁকে খুন করে।
অন্ধকার মেঝেয় এখনও পুরোপুরি শুকোয়নি রক্তের দাগ। অবিন্যস্ত ঘরের এককোণে গ্যাস ওভেন। পাশে সারিবদ্ধ কৌটো-বোতলে নানা খাবার। একটা তক্তার উপরে রাখা আরডি মুন্ডার লেখা বই ‘ঝাড়খণ্ড মুভমেন্ট।’ সযত্নে সাজানো বেশ কিছু ফাইলও। যার একটা খুলে দেখা গেল, ‘পানেম কোল মাইনস লিমিটেড’-এর বেশ কিছু কাজের ওয়ার্ক অর্ডার।
পাচুয়াড়ার দশ কিলোমিটার দূরে কাঁঠালডিহির এই বেসরকারি কয়লাসংস্থার জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে পাচুয়াড়ায় আন্দোলন সংগঠিত করেই স্থানীয় আদিবাসী জনতার কাছে সিস্টার ওয়ালসা ‘মসীহা’ হয়ে উঠেছিলেন। আবার সম্প্রতি ওই কয়লাসংস্থার সঙ্গেই ‘ঘনিষ্ঠতা’-র অভিযোগে তিনি বাসিন্দাদের একাংশের বিরাগভাজন হয়ে পড়েছিলেন বলে পাকুড় জেলা পুলিশের এক কর্তার দাবি। উল্লেখ্য, হত্যাকাণ্ডের পরে পরেই স্থানীয় বিধায়ক সাইমন মারান্ডি অভিযোগ তোলেন, বাস্তবে সিস্টার ওয়ালসা কয়লাসংস্থাটির হয়ে কাজ করছিলেন। সন্ন্যাসিনীর টাকার মোহ ক্রমে বাড়ছিল বলেও মন্তব্য করেন মারান্ডি। নাম প্রকাশ না-করার শর্তে গ্রামবাসীদেরও একাংশ সিস্টারের সঙ্গে ‘পানেম-ঘনিষ্ঠতা’র কথা বলেছেন।
এখানেই খুন হন ওয়ালসা। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।
তা হলে কি সিস্টার-হত্যা এই সব ক্ষোভ-আক্রোশেরই পরিণতি? উত্তর স্পষ্ট নয়। খুনের জায়গায় পুলিশ কিছু ‘মাওবাদী’ নামাঙ্কিত পোস্টার পেয়েছে। সেগুলো তদন্তকারীদের বিভ্রান্ত করার জন্যও ছড়ানো হয়ে থাকতে পারে বলে পুলিশের একাংশের ধারণা। পুলিশ অবশ্য মাওবাদীদের হাত থাকার সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়েও দিচ্ছে না। সব মিলিয়ে ধোঁয়াশা যথেষ্ট।
স্থানীয় সূত্রের খবর: ১৯৯৫-এ ঝাড়খণ্ডের দুমকায় গোপীকাঁদর থানার ফতিমা মধ্য বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে এসেছিলেন ওয়ালসা। ’৯৮-এ পাকুড়ের আমড়াপাড়া থানার এই পাচুয়াড়া গ্রামে এসে থাকতে শুরু করেন। গত জুলাই পর্যন্ত পাইসিল হেমব্রমের বাড়ির ছোট্ট টালির ঘর ছিল তাঁর আস্তানা। ওখানে ডেরা বেঁধে তিনি স্থানীয় আদিবাসীদের উন্নয়নের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। পাচুয়াড়ার বারোটোলায় সরকারি প্রাথমিক স্কুলের পাশে রাস্তার ধারে গড়ে তোলেন স্বাস্থ্যপরীক্ষা কেন্দ্র। বাঁশের বেড়া, খড়ের ছাউনির স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বাইরে থেকে ডাক্তার আনার ব্যবস্থা করেছিলেন। ডাক্তারেরা রোজ সকালে শিশু, প্রসূতি, অসুস্থদের দেখতেন। ওষুধ-পথ্যের তদারকি করতেন সিস্টার। বারোটোলার শেষ প্রান্তের মাঠে বাঁশ-খড় দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন স্কুল। পাশে পানীয় জলের ব্যবস্থা। পড়ুয়াদের জন্য খেলার মাঠ।
এখন স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ। স্কুলও পাট গুটিয়েছে।
সকালে গ্রামের রাস্তা ধান শুকোচ্ছিলেন খুলি হেমব্রম। প্রৗঢ়ার ডান পায়ের হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত ঘা। বললেন, “কাকে দেখাব? সিস্টার নিজের হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিলেন। কী করে এমন হল, বুঝতে পারছি না।” বন্ধ স্কুলের পাশে দেখা গেল, কচিকাঁচারা গুলতি নিয়ে খেলছে। পড়াশোনা আবার শুরু হবে, এমন ভরসা মিলল না কারও কাছে।
কী করে কী হল, কোনও আন্দাজ কেউ দিতে পারছেন না?
সিস্টারের কাছে লেখাপড়া শিখে মাধ্যমিক পাশ করেছেন সোনারাম মুর্মু। এফআইআরে পানেম-কর্মী ওই যুবকের বয়ানের ভিত্তিতেই পুলিশ সন্ন্যাসিনী-হত্যার মামলা রুজু করেছে। উল্লেখ্য, পাইসিলের দাদা আনন্দ হেমব্রম মাস চারেক আগে হঠাৎ সিস্টারকে ‘হুমকি দিয়ে বাড়িছাড়া’ করার পরে সোনারামের বাড়িতেই ঠাঁই হয়েছিল তাঁর। অভিযোগের তালিকায় ৫০ জন অজ্ঞাতপরিচয়ের নাম আছে। পুলিশ ইতিমধ্যে পাইসিল-সহ ৭ জনকে গ্রেফতার করেছে। কী বলছেন সোনারামেরা?
সোনারামের দাবি, “পাইসিল, আনন্দের মতো গ্রামের অনেকের রোষে পড়েছিলেন সিস্টার। নিজেদের ব্যবসার খাতিরে ওরা সিস্টারকে চাইছিল না।” সোনারামের দাদা মুন্সি হেমব্রমের বক্তব্য, “সিস্টারকে যখন ওরা তাড়িয়ে দিল, উনি আমাদের কাছে আশ্রয় চেয়েছিলেন। আমরা আদিবাসী প্রথা মেনে মাঝি হারানকে (গ্রামের মোড়ল) বলে এখানে সিস্টারের থাকার বন্দোবস্ত করেছিলাম। কিন্তু গ্রামের অনেকে চাইত না, সিস্টার এখানে থাকুন। ওরা ওঁকে পানেমের দালাল পর্যন্ত বলত!”
এবং সোনারামের দাবি, গ্রামের কিছু লোক যে তাঁকে পছন্দ করছে না, সিস্টার তা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন। এমনকী, নিজের প্রাণহানির আশঙ্কাও করছিলেন। কী ভাবে জানলেন?
সোনারামের জবাব, “সিস্টার মাঝে মাঝে আমাদের বলতেন, মনে হয় তোমাদের ছেড়ে চলে যেতে হবে। ওরা আমাকে ভুল বুঝছে। কিন্তু আমি তো ওদের ভালই চাই!”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.