ভাবতে হবে দেশীয় বাস্তবতা, বললেন ইয়েচুরিকে
অনুকরণে ক্ষতি বামেদের, মানছেন হবসবম
চিনই হোক বা লাতিন আমেরিকা, কোনও আন্তর্জাতিক মডেলকে অন্ধ ভাবে অনুকরণ না করে সম্পূর্ণ ভারতীয় মডেলে কমিউনিস্ট পার্টিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি এ বার আসন্ন পার্টি কংগ্রেসে আলোচনা করবে সিপিএম শীর্ষ নেতৃত্ব।
সম্প্রতি লন্ডনে পলিটব্যুরো নেতা সীতারাম ইয়েচুরির সঙ্গে মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক এরিক হবসবমের এক দীর্ঘ বৈঠক হয়। এই বিষয়টি নিয়ে দু’জনের মধ্যে আলোচনা হয়। হবসবমও মনে করেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিএসইউ)-র আধিপত্যে আন্তর্জাতিক আন্দোলন সেই সময়ে বিকশিত হয়েছিল বলেই এই আন্দোলন অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সীতারাম তাঁকে বলেন, সিপিএমের জন্মই হয়েছিল এই ধরনের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার মধ্যে দিয়ে। সেই ঐতিহ্যই আমরা বহন করে নিয়ে যেতে চাই।
হবসবম তখন বলেন, ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গেলে ভারতীয় বাস্তবতার উপলব্ধিটা থাকা আজও খুব প্রয়োজন। লেনিনের সঙ্গে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের কমিনটার্নের মধ্যেই যে বিতর্ক হয়েছিল, তারও বিষয়বস্তু ছিল জাতীয়তার প্রশ্ন। কিন্তু সেই সময় দলীয় নেতারা এই বিতর্ককে ভালো চোখে নেননি। সেই সময় লেনিন যখন আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আন্তর্জাতিক মঞ্চ গড়ে তোলার কথা বলছেন, সেই সময় মানবেন্দ্রনাথ রায় ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটা তুলেছিলেন। ১৯১৯ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত এই বিতর্ক চলে। লেনিনের যুক্তি ছিল, পুঁজিবাদ এখন তার অন্তিম পর্ব সাম্রাজ্যবাদে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু মানবেন্দ্র নাথ রায় বলেন, ভারতের পুঁজিবাদী শ্রেণিকে আলাদা করে বোঝার প্রয়োজন আছে। এই পুঁজিবাদী শ্রেণির অভ্যন্তরীণ লড়াইকে দেখে মনে করার কোনও কারণ নেই যে পুঁজিবাদ উৎখাত হয়ে যাবে। কিন্তু সেই বিতর্কে লেনিনের অবস্থানটাই মূলত দলে গৃহীত হয়েছিল।
এত দিন পর হবসবম বলছেন, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন বুঝতে গেলে খোলা মনে আবার সেই বিতর্কটা নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। সীতারাম লন্ডনে গিয়েছিলেন রজনীপাম দত্ত স্মারক বক্তৃতা দিতে। ওই সময়ই হবসবমের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। সে সময় সেন্ট পল্স ক্যাথেড্রালের সামনে ‘অকুপাই লন্ডন’ বিক্ষোভকারীদের সামনে বক্তৃতা দেন ইয়েচুরি। তার পরেই যান হবসবমের সঙ্গে দেখা করতে। এটা শুনে হবসবম মন্তব্য করেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পশ্চিমী দুনিয়ায় এই প্রথম পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষ বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। এর আগে যত আন্দোলন হয়েছে, সবই হয়েছে উন্নত মানের জীবনযাত্রার দাবিতে। কিন্তু এই মূল প্রশ্ন নিয়ে আন্দোলন হয়নি। পশ্চিমী দুনিয়ায় গোটা ব্যবস্থাটাকে পরিবর্তন করার দাবি উঠছে এই প্রথম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এ-ও মন্তব্য করেন, ব্রিটেনে ব্যবস্থা বদলানোর মতো পরিস্থিতি নেই। তবে লাতিন আমেরিকায় এ বিষয়ে ইতিবাচক অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইউরোপের মধ্যে গ্রিস ও পর্তুগালে এই সংগ্রাম এগোচ্ছে। ইতালির মতো দেশে এই আন্দোলন আরও বেশি হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। ভারতে বাম দলগুলির নির্বাচনী বিপর্যয় সম্পর্কে হবসবমের বক্তব্য, এটা অস্থায়ী। আগামী দিনে আবার বাম আন্দোলনকে শক্তিশালী করা সম্ভব হবে বলে তিনি আস্থাশীল।
ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলন সম্পর্কে সিপিএমের প্রকাশিত বইটি হবসবম পড়েছেন। প্রথম ভাগের পর এ বার দ্বিতীয় ভাগটি পড়ার জন্য তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। দলের ইতিহাস কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন হরকিষেণ সিংহ সুরজিত। তিনিই ছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলন নিয়ে এই বইটি লেখার রূপকার। তাঁর মৃত্যু হয়। এর পরে আবার কমিশনের অন্য সদস্যদের মধ্যে অনিল বিশ্বাস, পি রামচন্দ্রন এবং কে সত্যনারায়ণ মারা যান। ফলে বইটি প্রকাশে দেরি হয়েছে বলে সীতারাম জানান। তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেন, শীঘ্রই বইটি প্রকাশিত হবে।
রজনীপাম দত্ত স্মারক বক্তৃতা দিতে সীতারাম কেমব্রিজে এসেছেন শুনে হবসবম স্মৃতিচারণ করে বলেন, গোটা পৃথিবী জুড়ে তখন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিল। রজনীপাম দত্তের মতো অনেক উজ্জ্বল ও সৃজনশীল মানুষ এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। মৃত্যুবরণও করেছেন। তাঁরা অনেকেই জানতেন, স্পেনে জেনারেল ফ্র্যাঙ্কো জিতবেন। তবে হিটলার পরাস্ত হবেন, সেই নিশ্চয়তাও ছিল না। তা সত্ত্বেও তাঁরা লড়াই করেছিলেন। সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে একতা খুবই জরুরি ছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে এর পরে অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি হয়েছে স্বীকার করে হবসবম বলেন, এখনও পৃথিবীতে মানুষের সুষ্ঠু জীবনের জন্য অনেক আন্দোলন হয়ে চলেছে।
হবসবম শেষ ভারতে এসেছিলেন ২০০৫ সালে। সে সময় তিনি তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী নটবর সিংহের সঙ্গে বৈঠক করেন। আবার তাঁর ভারতে আসার ইচ্ছা। কিন্তু শরীর ও বয়সের ভারে কবে আসতে পারবেন, বুঝতে পারছেন না। তবে এটা স্পষ্ট, হবসবমের মতো তাত্ত্বিকও মনে করেন, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিকে লেজুড়বৃত্তি ছেড়ে করে অনেক বেশি ভারতীয় হয়ে ওঠাই বাঞ্ছনীয়।
সম্প্রতি চিনা কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে হু জিনতাও চিনা বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে চিনের কমিউনিস্ট পার্টিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। সিপিএমের আসন্ন পার্টি কংগ্রেসের মতাদর্শগত দলিলের খসড়া তৈরিতেও বিতর্ক হচ্ছে ভারতীয়ত্বের প্রশ্নে। প্রকাশ কারাট নিজেও অন্ধ ভাবে চিনা পার্টির অনুসরণ করার বিপক্ষে মতামত দিয়েছেন। আবার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো নেতারা চিনা কমিউনিস্ট পার্টির অনেক প্রশাসনিক উপাদান গ্রহণ করতে চাইলেও, তা ভারতীয় প্রেক্ষাপটেই করার পক্ষে।
হবসবমের সঙ্গে সীতারামের বৈঠক এই বিতর্ককে এক নতুন মাত্রা দিল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.