না কোনও বিতর্ক, না আলোচনা। মাত্র ১১ মিনিটে দেশের বৃহত্তম রাজ্য উত্তরপ্রদেশকে চার টুকরো করার প্রস্তাব বিধানসভায় পাশ করিয়ে নিলেন মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী। আর তেলেঙ্গানার আগুনে ‘মুখ পোড়ানো’ কংগ্রেস উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনের মাত্র পাঁচ মাস আগে বসপা নেত্রীর এই রাজনৈতিক চালে বেশ খানিকটা বেসামাল। রাজ্য সরকারের প্রস্তাব কেন্দ্রে পৌঁছলে আপাতত তা ঝুলিয়ে রাখার কৌশলই নিতে চলেছে তারা।
আজ বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী প্রস্তাব আনেন, ‘সুশাসনের লক্ষ্যে চার ভাগ হবে উত্তরপ্রদেশ— পূর্বাঞ্চল, অবধপ্রদেশ, পশ্চিমাঞ্চল এবং বুন্দেলখণ্ড।’ তার পরে কোনও আলোচনার অবকাশ না রেখে ধ্বনি ভোটে সেই প্রস্তাব পাশ হতে সাকুল্যে সময় লাগে ঠিক ১১টি মিনিট। তার পরেই কেন্দ্রের কোর্টে বল ঠেলে দিতে মাঠে নামলেন বসপা নেত্রী। সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়ে দিলেন, “সুশাসনের লক্ষ্যে দেশের সব থেকে জনবহুল এই রাজ্য পুনর্গঠনের জন্য বসপা সরকার বহু দিন ধরেই আলোচনা চালাচ্ছে। কিন্তু উদাসীন ছিল কেন্দ্র। তবে রাজ্য তার দায়িত্ব পালন করেছে। এ বার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার কেন্দ্রের।”
প্রশ্ন হল, মায়াবতী সরকারের এই সিদ্ধান্ত কতটা আঞ্চলিক আবেগ তাড়িত, কতটাই বা রাজনৈতিক?
সুশাসন যে মায়াবতীর লক্ষ্য নয়, আজ সেই অভিযোগ তুলেছে রাজ্যের তামাম বিরোধী দল। সপা, কংগ্রেস, বিজেপি-সহ বিরোধী সব দলের বিধায়করাই আজ বিধানসভায় হট্টগোল করেন। কিন্তু মুশকিল হল, এক মাত্র মুলায়ম ছাড়া কংগ্রেস বা বিজেপি কারও পক্ষেই উচ্চ স্বরে বলা সম্ভব হচ্ছে না যে রাজ্য ভাগে আপত্তি রয়েছে তাদের। কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকার কারণে এখন সব থেকে ফাঁপরে পড়েছে কংগ্রেসই।
বস্তুত উত্তরপ্রদেশ বিভাজন কংগ্রেসও চায়। রাজ্য নেতৃত্ব দু’বছর আগে বারাণসী অধিবেশনে এ ব্যাপারে প্রস্তাবও পাশ করিয়েছিল। কিন্তু পৃথক তেলেঙ্গানার দাবিতে যখন অন্ধ্রপ্রদেশ জ্বলছে, তখন উত্তরপ্রদেশ ভাগের প্রস্তাবে এখনই সায় দিয়ে দেওয়া কংগ্রেসের পক্ষে মুশকিল। কারণ, তা হলেই ফের তেতে উঠবে তেলেঙ্গানা। কেন্দ্রের সেই সঙ্কট আঁচ করেই ভোটের আগে মোক্ষম চালটি দিয়েছেন মায়াবতী। |
এ ভাবে তড়িঘড়ি রাজ্য ভাগের বিরোধিতা করেছে বিজেপিও। এই অবস্থায় সেটাই এখন কংগ্রেসের কাছে একমাত্র স্বস্তির বিষয়। বিরোধিতার স্রোতে এখন গা ভাসিয়ে রাখতে চায় কংগ্রেসও। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী সলমন খুরশিদ বা কংগ্রেস মুখপাত্র মণীশ তিওয়ারির কথায়, “উত্তরপ্রদেশ হল দেশের হৃদয়খণ্ড। তাকে এ ভাবে মাত্র ১১ মিনিটে চার টুকরো করে ফেলা যায় না। মায়াবতী যে স্রেফ রাজনীতি করছেন, তা সকলেই বুঝতে পারছেন। কংগ্রেস মনে করে উত্তরপ্রদেশকে ভাগ করার আগে রাজনৈতিক সর্বসম্মতি গড়ে তোলা প্রয়োজন।”
কিন্তু মায়াবতী রাজ্য ভাগের প্রস্তাব কেন্দ্রের কাছে পাঠালে মনমোহন সরকার কী করবেন?
সরকার ও কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতার কথায়, কেন্দ্রের তরফে এই কথাই বলা হবে, যে ভাবে কোনও সমীক্ষা ও আলোচনা ছাড়া রাজ্য ভাগের প্রস্তাব করা হয়েছে, তার উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। প্রস্তাবিত চার রাজ্যের আওতায় জেলার সংখ্যার বিন্যাস নিয়ে নানা মত রয়েছে। চার রাজ্যের রাজধানীগুলি কী হবে, তা-ও মায়াবতী সরকার ঠিক করেনি। এই প্রশ্নও উঠছে, বিধানসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার ঠিক আগে কেন তড়িঘড়ি এই প্রস্তাব পাশ করানো হল? সুতরাং ভোটের পর নতুন বিধানসভা যদি এই প্রস্তাবে সম্মতি দেয়, তবেই কেন্দ্র তা বিবেচনা করবে। অর্থাৎ, বিপাকে পড়লেও রাজনীতির পাল্টা চাল দেওয়ার কথাই ভাবছে কংগ্রেস।
তবে রাজ্য ভাগের প্রস্তাব পাশ করিয়ে মায়াবতী কেবল কেন্দ্র তথা কংগ্রেসকেই চাপে ফেলেননি, নিজের দুর্গও মজবুত করতে চেয়েছেন। মাস কয়েক ধরেই জল্পনা ছিল, মায়াবতী সরকার তলে তলে দুর্বল হয়ে পড়েছে। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে দলের ৭০ জন বিধায়ককে মায়াবতী ফের টিকিট না দেওয়ায় তাঁরা সরকার ফেলতে সক্রিয় হয়েছেন। অন্য দলগুলির সঙ্গে আঁতাঁত করে তাঁরা বিধানসভায় অনাস্থা প্রস্তাব আনতে চাইছেন। বস্তুত বিজেপি আজই বিধানসভায় অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিল। তার পরে রাজ্য ভাগের প্রস্তাব বিধানসভায় পেশ হতেই বিরোধী সদস্যরা একযোগে হট্টগোল শুরু করেন। সেই সুযোগে ধ্বনি ভোটে রাজ্য ভাগের প্রস্তাবটি পাশ করিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু প্রস্তাব পাশ করানোকেও রাজনৈতিক পুঁজি করেন মায়াবতী। সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “সরকারের যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে সেটাও প্রমাণ হল। বিরোধীরা বৃথাই অপপ্রচার চালাচ্ছিল। সীমানা পুনর্বিন্যাসের জন্য কিছু বসপা বিধায়কের নির্বাচন কেন্দ্র পরিবর্তন হয়েছে। তাঁরা নিজেরাই এ বার প্রার্থী হতে চাননি। কিন্তু তা নিয়েও রাজনীতি করছে বিরোধীরা।”
ভোট যত এগিয়ে আসছে, ততই উত্তপ্ত হচ্ছে উত্তরপ্রদেশ। নতুন পরিস্থিতিতে কাল থেকে ফের তিন দিনের জন্য উত্তরপ্রদেশে প্রচারে যাচ্ছেন রাহুল গাঁধী। রাজ্য ভাগ নিয়ে মায়াবতীর কৌশলের জবাব কাল রাহুল কী ভাবে দেন, সকলের নজর এখন সে দিকেই। |