এ যেন ছায়ার সঙ্গে কুস্তি!
আগামিকাল সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হতে চলেছে। আগামী এক মাস শাসক দল কংগ্রেসের সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ, সেই ছায়ার সঙ্গে লড়াই। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব আজ বলছেন, ‘ইউপিএ-২ সম্পর্কে আমজনতার মনে যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, সেই ধারণার সঙ্গেই লড়তে হবে আমাদের।’
ধারণাটা কী?
কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব স্বীকার করছেন, প্রথম ইউপিএ সম্পর্কে মানুষের ধারণা ছিল, মনমোহন সিংহের সরকার হিম্মত রাখে। বামেদের বিরোধিতা সত্ত্বেও তারা পরমাণু চুক্তি করে দেখিয়ে দিয়েছে। দুর্নীতির কোনও অভিযোগ সেই সরকারকে কালিমালিপ্ত করতে পারেনি। মূল্যবৃদ্ধি ছিল নিয়ন্ত্রণে। আর আজ ইউপিএ-র দ্বিতীয় অধ্যায়ে যখন সরকারের আড়াই বছর অতিবাহিত, তখন গোটা দেশ জুড়ে ধারণা তৈরি হয়েছে, টু-জি এবং কমনওয়েল্থ কেলেঙ্কারির পঙ্কে সরকার নিমজ্জিত। জিনিসের দাম লাগামছাড়া। সরকার এবং দলের মধ্যে চূড়ান্ত সমন্বয়হীনতা। সরকারের ভিতর রথী-মহারথীদের নিজস্ব লড়াই। শরিক দলগুলি ফুঁসছে। আর এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিরোধী শিবির, মূলত বিজেপি এ বার ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে সংসদে।
ফলে এক মাসের এই অধিবেশনে প্রাক মুহূর্তে কংগ্রেস শিবিরে এক অসহায়তার চিত্র। কংগ্রেস দলনেতা প্রণব মুখোপাধ্যায় দুই বিরোধী নেতা অরুণ জেটলি ও সুষমা স্বরাজকে ডেকে অনুরোধ করেছেন, “আপনারা গুরুত্বপূর্ণ বিলগুলি পাশ করতে দিন। বিল পাশ না হলে সরকার চলবে কী করে? আবার বিল পাশ না হলে আপনারাই বলবেন, সরকার কাজ করছে না। কিন্তু গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ইতিবাচক ভূমিকাও খুব জরুরি।” অরুণ-সুষমা প্রণববাবুকে কথা দিয়েছেন, তাঁরা সংসদ অচল করতে চান না।
কিন্তু কথা দিলে কী হবে? প্রণববাবু থেকে আহমেদ পটেল, সকলেরই সন্দেহ, কাজে তাঁরা সেটা করবেন কি না! উল্টে কংগ্রেস নেতারা মনে করছেন, এটা লালকৃষ্ণ আডবাণীর একটা কৌশল হতে পারে যে, প্রথমে কোনও ঝামেলা হবে না এমন আশ্বাস দিলেও, পরে তাঁরা এমন দাবি তুলবেন, যা কংগ্রেসের পক্ষে মানা সম্ভব নয়। তখন তাঁরা সংসদ অচল করে রাখবেন। ফলে বিমা, ব্যাঙ্ক, পেনশন, খাদ্য সুরক্ষার মতো নানা বিল পাশ করা সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। বস্তুত, কংগ্রেসের আশঙ্কা যে সত্যি হতে পারে সেই ইঙ্গিত দিয়ে বিজেপি নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেন, “সংসদ অচল করাটা আমাদের
উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু সংসদ চলবে কি না, সেটা নির্ভর করছে সরকারের আচরণের উপর।”
কংগ্রেস অবশ্য টু-জি স্পেকট্রাম নিয়ে সিবিআই তদন্তকে মূলধন করে বিজেপি-র দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনের পালের বাতাস কেড়ে নিতে চায়। এনডিএ আমলে টেলিকম দুর্নীতি হয়েছিল কি না, তা নিয়ে এখন তদন্ত শুরু করেছে সিবিআই। তারা কাঠগড়ায় তুলছে প্রমোদ মহাজনকে। এই অবস্থায় দুই শিবির থেকেই দুর্নীতি নিয়ে আরও নতুন তথ্য সংসদে পেশ হওয়ার কথা। কিন্তু তার আগে মানসিক ভাবে যে বিজেপি কিছুটা হলেও এগিয়ে, তাতে সন্দেহ নেই। আডবাণীর রথযাত্রা এবং গত কাল দিল্লিতে জনসভার সাফল্য তাদের উজ্জীবিত করেছে। আডবাণীরা এক দিকে যেমন দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে সফল, তেমনই পাশে পেয়েছেন সব শরিককেই। সঙ্গে বাড়তি পাওনা জয়ললিতার প্রতিনিধির উপস্থিতি।
অন্য দিকে, কংগ্রেসের ছবিটা রীতিমতো ছন্নছাড়া। এক শীর্ষ কংগ্রেস নেতার মতে, দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের শুরু থেকেই দল ও সরকারের মধ্যে মতৈক্যের অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রথম ইউপিএ সরকারে সনিয়া গাঁধী ও মনমোহন সিংহের মধ্যে সমন্বয় ছিল অনেক বেশি। কেউ কোনও কথা বললে অন্য জন তা মেনে নিতেন। একটি উদাহরণ দিয়ে ওই শীর্ষ নেতা বলেন, পরমাণু চুক্তির সময় ইরান প্রশ্নে মার্কিন অবস্থানে সায় দিতে চেয়েছিলেন মনমোহন। এ নিয়ে মন্ত্রিসভার রাজনীতি বিষয়ক কমিটিতে আলোচনাও শুরু হয়েছিল। কিন্তু সনিয়া বলেছিলেন, ভারত ইরানের কাছ থেকে সব থেকে বেশি তেল পায়। অতএব আমেরিকাকে খুশি করতে গিয়ে তাদের বিরোধিতা করা উচিত হবে না। সে কথা সে দিন মনমোহন মেনে নেন। আর আজ মন্ত্রিসভার রদবদল থেকে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি কোনও প্রশ্নেই দল-সরকারের শীর্ষ স্তরে সহমত হচ্ছে না। সিদ্ধান্ত থমকে থাকছে। ফলে আমজনতার কাছে বার্তা যাচ্ছে, সরকার দুর্বল।
কংগ্রেসের ওই শীর্ষ নেতার কথায়, “খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সংসদে বিল আনার দরকার নেই। কিন্তু মন্ত্রিসভাই এই সিদ্ধান্ত নিতে হিমসিম খাচ্ছে। দলীয় মুখ্যমন্ত্রীরাই এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে। আবার উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের আগে এই সিদ্ধান্ত হলে হিন্দি বলয়ের বৈশ্য সম্প্রদায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে, এমন আশঙ্কাও রয়েছে।”
প্রণববাবু অবশ্য মনে করেন, পরিস্থিতিটা এতটা হতাশার নয়। শতকরা ৮ ভাগ আর্থিক বৃদ্ধি তো হচ্ছেই। চূড়ান্ত আন্তর্জাতিক মন্দাতেও ভারতের পরিস্থিতি অন্য বহু রাষ্ট্রের তুলনায় ভাল। পশ্চিমের তুলনায় ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলিতে যথেষ্ট আর্থিক শৃঙ্খলা রয়েছে। দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নেই। মজুত বিদেশি মুদ্রার ভাঁড়ার খুব খারাপ নয়। বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনগুলিতে সম্প্রতি কংগ্রেসের ফলাফল মন্দ নয়। সামাজিক দায়বদ্ধতা ও আর্থিক সংস্কারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে কংগ্রেস এগোতে চায়। মিডিয়ার একাংশে সরকার সম্পর্কে যে নেতিবাচক ধারণা গড়ে উঠছে, সেটার মোকাবিলা করাই সরকারের সব থেকে বড় কাজ।
বিরোধী নেতারা অবশ্য বলছেন, আজই শেয়ার বাজারে ধস নেমেছে। টাকার দাম ক্রমশ কমছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের আর্থিক সঙ্কটের জন্য শুধু বিশ্ব বাজারকে দোষী সাব্যস্ত করাটা বোধহয় উচিত নয়। সরকারের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়েছে বলেই মনমোহন সিংহ সংস্কার এবং উন্নয়নের প্রশ্নে যথেষ্ট কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। সামাজিক দায়বদ্ধতার নামে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও গ্রামীণ মানুষ তার ফায়দা পাচ্ছেন না। আবার রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে কংগ্রেসও এই প্রকল্প প্রত্যাহার করে নতুন প্রকল্প গ্রহণ করতে পারছে না।
তাদের এই দিশাহীনতার রাজনৈতিক ফায়দা নিতেই তেড়েফুঁড়ে আসরে নামছে বিজেপি। |