শেখ হাসিনার সরকারের আমলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আরও এক বার যৌথ পদক্ষেপ করল ভারত ও বাংলাদেশ। আজ দু’দেশের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকের শেষে নয়াদিল্লি ও ঢাকার বক্তব্যের নির্যাস, শুধু মাত্র ‘বকেয়া দ্বিপাক্ষিক বিষয়গুলিকে’ মিটিয়ে ফেলা নয়, সহযোগিতার ‘নতুন ক্ষেত্রগুলি’ খুঁজে দেখাটাও এখন উভয়ের লক্ষ্য। বৈঠকের পরে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘খুব শীঘ্রই’ দু’দেশের মধ্যে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তিটি চূড়ান্ত করা হবে।
২০০৯-এর শেষে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসার পরে দ্বিপাক্ষিক পরিস্থিতির যে আমূল পরিবর্তন হয়েছে, তা প্রকাশ্যে বারবারই স্বীকার করেছেন ভারতীয় কর্তারা। নর্থ ব্লকে গত তিন দিন ধরে চলা স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের এই বৈঠকের পরে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব আর কে সিংহ দিল্লির এই মনোভাব তুলে ধরে বলেছেন, “গত দেড় বছরে বাংলাদেশের কাছ থেকে যে সহযোগিতা পেয়েছি, তাতে আমরা খুবই খুশি। বাংলাদেশকে আমরা ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী হিসেবে গণ্য করি।” যার জবাবে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রসচিব মনজুর হুসেন বলেছেন, “গত দেড় বছরে যে বিশ্বাস এবং পারস্পরিক আস্থা তৈরি হয়েছে, তাকে অবলম্বন করেই এগিয়ে যেতে চাইছি আমরা। শুধু মাত্র বকেয়া বিষয়গুলি মেটানো নয়, দু’দেশেরই স্বার্থ রক্ষিত হবে, এমন নতুন ক্ষেত্রও খুঁজে দেখা হবে।
বাংলাদেশের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের এই বৈঠকের ফল ভারতের পক্ষে যথেষ্ট ইতিবাচক বলেই মনে করছেন কূটনীতিকরা। দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক নিরাপত্তার প্রশ্নটি যখন ভারতকে কাঁটার মত বিঁধছে, তখন সন্ত্রাস মোকাবিলায় বাংলাদেশকে পাশে পাওয়া বড় প্রাপ্তি হিসেবেই দেখছে সাউথ ব্লক। আজ আর কে সিংহের পাশে বসে মনজুর হুসেন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ঢাকার মাটিতে ভারত-বিরোধী জঙ্গি ঘাঁটি কোনও অবস্থাতেই সহ্য করা হবে না। তিনি এই আশ্বাসও দিয়েছেন যে, আইনি জটিলতা কাটলে আলফার সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ‘গুরুত্ব’ দিয়ে ভাবা হবে। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের হত্যাকারীদের মধ্যে দু’জন ভারতে আত্মগোপন করে রয়েছে, এই তথ্য নর্থ ব্লককে দিয়ে ঢাকার তরফে অনুরোধ করা হয়েছে যে, দ্রুত তাদের খুঁজে বের করে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়া হোক। নয়াদিল্লি জানিয়েছে, বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে দেখা হবে। যদি এমন কারও সন্ধান মেলে, তা হলে ‘আনন্দের সঙ্গেই’ ব্যবস্থা নেবে নয়াদিল্লি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের বক্তব্য, তিস্তার ‘জলসঙ্কট’ যাতে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে ছায়া ফেলতে না পারে, সে জন্য কূটনৈতিক প্রয়াস অব্যাহত রেখে চলেছে দু’টি দেশই। আজকের সাংবাদিক সম্মেলনেও তিস্তা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে কোনও নেতিবাচক বার্তা দিতে চাননি মনজুর হুসেন। শুধু বলেছেন, “তিস্তা এই আলোচনার কর্মসূচির মধ্যে ছিল না। কিন্তু আমরা অত্যন্ত আশাবাদী যে, খুব শীঘ্রই চুক্তিটি সম্পন্ন হবে।” কূটনৈতিক সূত্রের খবর, ছিটমহল থেকে শুরু করে অনুপ চেটিয়া বিভিন্ন বিষয় নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে দু’দেশের মধ্যে। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০১০ সালে হাসিনার ভারত সফরের সময় হওয়া তিনটি চুক্তি (পারস্পরিক আইনি সহায়তা, সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের বিনিময় এবং মাদক চোরাচালান দমন) এবং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরে সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। বন্দি প্রত্যর্পন চুক্তিটিও যাতে খুব শীঘ্রই চুড়ান্ত করা যায়, সে ব্যাপারে দু’টি দেশই একমত হয়েছে। তবে কবে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে, তা নির্দিষ্ট করে জানাতে চায়নি কোনও দেশই।
আজকের বৈঠকে একটি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য ভারতীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হাতে তুলে দিয়েছে ঢাকা। শেখ মুজিবর রহমান হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত দু’জন ভারতে লুকিয়ে রয়েছে বলে দাবি বাংলাদেশের। এদের এক জনের নাম রিসালদার মোসলেউদ্দিন। বৈঠকের পরে মনজুর বলেন, “আমরা এ ব্যাপারে যাবতীয় তথ্য ভারতকে দিয়েছি। আশা করা হচ্ছে, এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে নয়াদিল্লি।” জবাবে আর কে সিংহ বলেন, “যদি হত্যাকারীদের আমরা খুঁজে পাই, তা হলে আমরাও কিছু কম খুশি হব না। এ কথা আমরা বাংলাদেশ নেতৃত্বকে জানিয়ে দিয়েছি।”
অনুপ চেটিয়াকে ফেরৎ দেওয়ার প্রশ্নেও আজ ঢাকার বক্তব্যে যথেষ্ট আশাবাদী সাউথ ব্লক। বাংলাদেশে আশ্রয় চেয়ে সে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে আবেদন করেছে চেটিয়া। ফলে বিষয়টি এখন বাংলাদেশের আদালতের বিচারাধীন। ঢাকার বক্তব্য, সেই আইনি জটিলতা মিটে গেলেই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে। তবে অনেক ভারতীয় জঙ্গি এখন আবার বাংলাদেশে গিয়ে ঘাঁটি তৈরি করছে, দিল্লির এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। মনজুরের কথায়, “বাংলাদেশের মাটিতে কোনও ভারত বিরোধী শক্তিই আর সক্রিয় নেই। এক-আধটা খুচরো ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু সার্বিক ভাবে এই ধরনের কোনও ঘটনা বাংলাদেশ আদৌ সহ্য করবে না।” |