সন্তানকে সামনে রেখেই পেরোলেন সঙ্গীদের নজরদারি
কমাত্র পুত্রসন্তান বাহাদুরকে ডাক্তার দেখাতে হবে। তাই ঝাড়খণ্ড ছেড়ে যেতে হবে পশ্চিমবঙ্গে।
আসলে যেতে হবে পুরুলিয়া জেলা পুলিশের কাছে!
সংক্ষেপে এই হল মাওবাদী ‘গেরিলা নেত্রী’ জাগরী বাস্কের আত্মসমর্পণের অন্তরালের পরিকল্পনা।
বেশ কিছু দিন ধরেই জাগরী পুলিশের হাতে ধরা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করছিলেন। মাধ্যম প্রাথমিক ভাবে একদা মাওবাদী, আপাতত পুলিশি হেফাজতে গুরুচরণ ওরফে ‘মার্শাল’। দ্বিতীয়, নিজের পরিবার। তখনও জাগরী ঝাড়খণ্ডে। মাওবাদীদের হাতে ‘নজরবন্দি’। কারণ, প্রথম তাঁর আত্মসমর্পণের ইচ্ছের কথা জানাজানি হতেই তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল ছত্তীসগঢ়ে। ছেলের অসুস্থতার কথা বলে ঝাড়খণ্ডে ফিরে আসার পরেও তাঁর উপর ‘নজর’ রাখা হত অহরহ। কিন্তু তার মধ্যেই পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ির বকডোবা গ্রামে তাঁর পরিবার এবং মার্শালের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন জাগরী।
মেয়ের ‘বার্তা’ পেয়ে মা গুরুবারি বাস্কে প্রথমে গিয়েছিলেন বেলপাহাড়ির এক রাজনৈতিক নেতার কাছে। যিনি মাওবাদী আন্দোলনে যোগ-দেওয়া যুবক যুবতীদের প্রতি ‘সহানুভূতিশীল’, এলাকার উন্নয়নের দাবিতে এবং শাসকের বিরুদ্ধে তাঁদের ‘লড়াই’-কে অশ্রদ্ধা করেন না। সেই ‘হিতৈষী’-কে জাগরীর মা বলেছিলেন, মেয়ে-জামাইকে তিনি তাঁর কাছেই দিয়ে যেতে চান। তিনিই যেন তাঁদের ‘দায়িত্ব’ নেন। প্রবীণ নেতা গুরুবারিকে অভয় দিয়ে পরামর্শ দেন পুলিশের কাছেই যেতে।
তার পরেই তাঁদের গ্রামের অনতিদূরে রসিকনগর সিআরপি ক্যাম্পে গিয়ে গুরুবারি প্রথম খবর দেনবছর আটেক আগে বাড়ি ছেড়ে মাওবাদী স্কোয়াডে চলে-যাওয়া তাঁর মেয়ে জাগরী সপরিবার পুলিশের হাতে ধরা দিতে চান।
রসিকনগর থেকে দ্রুত খবর যায় লাগোয়া জেলা পুরুলিয়ার বান্দোয়ান থানায়। ঠিক হয়, ছেলেকে ডাক্তার দেখানোর নাম করে জাগরী তাঁর স্বামী রাজারাম এবং ছেলে বাহাদুরকে নিয়ে ‘সুযোগ মতো’ চলে আসবেন প্রথমে গ্রামের বাড়িতে। সেখান থেকে সটান বান্দোয়ান থানায়।
বাস্তবে ‘প্রায়’ তা-ই ঘটেছে। ছেলের জ্বর-সর্দি-কাশি হয়েছে বলে ‘নজরদার’-দের জানিয়ে জাগরী-রাজারাম কিছুদিন আগে ঝাড়খণ্ড থেকে সড়কপথে আসেন বেলপাহাড়িতে। স্কোয়াডে তাঁদের কিছু ‘বন্ধুভাবাপন্ন’ই তাঁদের মোটরসাইকেলে পৌঁছে দিয়েছিলেন এ রাজ্যের সীমানায়। যে কোনও সাধারণ দম্পতির মতোই। সাধারণ জামাকাপড়ে। তখন থেকেই তাঁরা ‘দলছুট’। বেলপাহাড়ি থেকে সরাসরি ছেলেকে নিয়ে রাজারাম যান প্রথমে রসিকনগর ক্যাম্প ও তার পর বান্দোয়ান থানায়। জাগরী রয়ে যান ‘নিরাপদ আশ্রয়ে’। তিনি দেখতে চাইছিলেন, রাজারামের সঙ্গে পুলিশ কী ব্যবহার করে। পুলিশি ব্যবহার সম্পর্কে ‘পুরোপুরি নিশ্চিত’ হওয়ার পরেই জাগরী যান থানায়।
বাহাদুরের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী। মহাকরণে। নিজস্ব চিত্র
রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর, তার পর থেকে তাঁরা পুরুলিয়া জেলা পুলিশের হেফাজতেই ছিলেন। দিন তিনেক আগে তাঁদের আনা হয় কলকাতায়। গত কয়েক দিনে তাঁদের জেরা করে যথেষ্ট ‘তথ্য’ পাওয়া গিয়েছে বলেই দাবি পুলিশের। কিন্তু জাগরী যে মাপের মাওবাদী নেত্রী, তাতে তাঁকে সপরিবার মহাকরণে নিয়ে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে, সংবাদমাধ্যমের ভরপুর উপস্থিতিতে হাজির করানোই শ্রেয় মনে করেছে পুলিশ। আত্মসমর্পণ পর্ব যাতে যথেষ্ট ‘নাটকীয়’ হয়, সে জন্য তাঁদের জংলা-ছাপ পোশাক, টুপি (পরিভাষায় যাকে বলে ‘ব্যাট্ল ফেটিগ’ বা ‘ক্যামোফ্লেজ’) পরানো হয়েছিল। স্বরাষ্ট্র দফতরের এক পদস্থ অফিসারের কথায়, “জাগরীর মতো মাওবাদী নেত্রী মুখ্যমন্ত্রীর আত্মসমর্পণের আবেদনে সাড়া দিয়ে একেবারে মহাকরণে তাঁর কাছে গিয়ে হাজির হচ্ছেন, এই ঘটনার একটা সামগ্রিক তাৎপর্য রয়েছে। এর ফলে মাওবাদীদের একটা বড় অংশের কাছে প্রয়োজনীয় বার্তাও দেওয়া যাবে।”
রাজ্য পুলিশ সূত্রের খবর, আরও এক মাওবাদী নেত্রী আত্মসমর্পণ করতে চান। তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে বলেই প্রশাসনিক সূত্রের দাবি। তিনি এবং তাঁর স্বামী মাওবাদীদের ‘অ্যাকশন স্কোয়াডের’ সদস্য। প্রত্যাশিত ভাবেই সেই মহিলা মাওবাদীর নাম জানাতে চায়নি পুলিশ। কিন্তু রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্তা বলেছেন, “ও জাগরীর মতো এতটা প্রচারের আলোয় না এলেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।”
জাগরী ‘প্রচারের আলোয়’ এসেছিলেন মাওবাদীদের ‘গেরিলা নেত্রী’ হিসেবেই। ‘অ্যাকশনে’ তাঁর যতটা খ্যাতি ছিল, ‘রাজনৈতিক আদর্শগত’ দিক দিয়ে ততটা নয়। মার্শালের সঙ্গেই ঘর ছেড়েছিলেন প্রায় নাবালিকা জাগরী। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও তিনি বাড়িতে ফেরেননি। আদিবাসী এবং সাঁওতাল সংস্কৃতি জানা জাগরীর উপর দায়িত্ব ছিল সরেন-হাঁসদা-কিস্কু-মান্ডিদের উপর প্রভাব খাটিয়ে তাদের স্কোয়াডে টেনে আনার। স্কোয়াডেই তাঁর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয় রাজারামের। জন্ম হয় বাহাদুরের।
ঘটনাচক্রে, ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে জাগরীর বকডোবা গ্রামের বাড়িতে পৌঁছেছিল আনন্দবাজার। তখন অবশ্য জাগরীর মা গুরুবারি বলেছিলেন, তাঁর মেয়ে ‘দেশের কাজ’ করতে গিয়েছে। তখনও পুলিশ তাঁকে এবং জাগরীর বাবা ঠাকুরদাস বাস্কেকে যথেষ্ট ‘হেনস্থা’ করত তাঁদের মেয়ের খোঁজে। পুলিশ-ফাইলে জাগরীর কোনও ছবিও ছিল না! একটি মাত্র দুর্বল স্কেচ ছাড়া। তখন প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া সরাসরিই বলেছিলেন, “মেয়েটা তো কোনও খারাপ কাজে যায়নি! দেশের কাজ করতে গিয়েছে। পুলিশ-সরকার যা-ই বলুক, চুরি-ডাকাতি তো করতে যায়নি!”
এতদিন পরে মাওবাদী আন্দোলন সম্পর্কে যখন জাগরীর ‘স্বপ্নভঙ্গ’ হয়েছে (পিডব্লিউজি-এমসিসি সংযুক্ত হওয়ার পর দশ দফা কর্মসূচিতে বলা হয়েছিল, সাওঁতালদের স্কোয়াডে আনার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে বনবাসী-আদিবাসীদের রক্ষা করা হবে। কিন্তু পরবর্তী কালে দেখা যায়, মাওবাদীদের হাতে খুন-হওয়া মানুষের ৮০% আদিবাসী। এ নিয়ে অসন্তোষ দেখা দেওয়ার পর দল সিদ্ধান্ত নেয়, তারা সামগ্রিক ব্যবস্থার বদলের জন্য লড়বে। কোনও বিশেষ জনজাতির জন্য নয়। মার্শাল-জাগরীরা এ নিয়ে ব্লক স্তর থেকে আলোচনা চেয়েছিলেন। দল মানতে চায়নি। সেখান থেকেই স্বপ্নভঙ্গের শুরু। এর পর মার্শালের স্কোয়াড ছেড়ে বেরিয়ে-আসা। এবং জাগরীর ধরা দেওয়ার সিদ্ধান্ত), তখন অবশ্য শেষ পর্যন্ত পুলিশের কাছেই গিয়েছেন গুরুবারি। ধরা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর জাগরী তাঁকে জানান, কালক্রমে তাঁকে সপরিবার ‘এনকাউন্টারে’ মেরে দিতে পারে স্কোয়াড-সতীর্থরাই! তুলনায় পুলিশ ‘নিরাপদ’। বিশেষত, মুখ্যমন্ত্রী যখন প্যাকেজ-সহকারে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছেন।
পুলিশ সূত্রে খবর, হেফাজতে থাকাকালীন জাগরী জানিয়েছেন, তিনি রাজারামকে নিয়ে পুলিশের হাতে ধরা দিতে চান (জাগরী চেয়েছিলেন গুরুচরণ ওরফে মার্শালের সঙ্গেই ধরা দিতে), জানাজানি হওয়ার পরেই তাঁকে ‘অবিশ্বাস’ করতে শুরু করেন স্কোয়াডের অধিকাংশ সদস্য। তখনই রাজারামের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে তিনি ‘মূলস্রোতে’ ফেরার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন।
সেইমতো ‘অ্যাকশন স্কোয়াড’, অ্যাসল্ট রাইফেল, ল্যান্ডমাইনের জীবন ছেড়ে মোটরবাইকে সওয়ার।
পুরুলিয়া জেলা পুলিশের গেস্ট-হাউস। সরকারি গাড়িতে কলকাতা এবং কালক্রমে মহাকরণের অলিন্দে জীবনের মূলস্রোতে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.