সুস্থ জীবনে ফিরতে চাই, মমতার কাছে জাগরীরা
রাজ্য সরকারের ‘আহ্বানে’ সাড়া দিয়ে আত্মসমর্পণ করলেন মাওবাদী জঙ্গি রাজারাম সোরেন ও তাঁর স্ত্রী, সশস্ত্র স্কোয়াডের নেত্রী জাগরী বাস্কে। মহাকরণে বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়িয়েই সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসার কথা ঘোষণা করলেন ওই জঙ্গি দম্পতি। তাঁদের বক্তব্য, “মাওবাদীরা ভুল পথে চালিত করছে বুঝেই বেরিয়ে এসেছি। এ বার সুস্থ জীবনে ফিরতে চাই।” অন্য মাওবাদীদেরও মূল স্রোতে ফেরার আর্জি জানিয়েছেন তাঁরা।
জঙ্গলমহলে ‘কড়া’ অবস্থান নিয়ে রাজ্য সরকার যৌথ বাহিনীর অভিযান জোরদার করার সঙ্গে সঙ্গেই এই দম্পতির ‘আত্মসমর্পণ’ মাওবাদীদের কাছে একটি বড় ‘ধাক্কা’ বলে মনে করছে প্রশাসনের একাংশ। ১৯৯৮ সাল থেকে মাওবাদীদের সঙ্গে জড়িত ৩৬-৩৭ বছরের রাজারাম ওরফে সাগেন সাঁওতাল এ রাজ্য এবং ঝাড়খণ্ডের লাগোয়া এলাকায় মাওবাদীদের প্রথম সারির জঙ্গি নেতা। ২০০৫-০৬ সালে রাজারাম-জাগরীরা মিলেই পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের প্ল্যাটুন একেবারে শূন্য থেকে গড়ে তুলেছিলেন বলে পুলিশ সূত্রের বক্তব্য। ওই সময়েই দু’জনের বিয়ে হয়। পুরুলিয়ার বরাভূম স্টেশনে রেল সুরক্ষা বাহিনীর (আরপিএফ) জওয়ানদের খুন করে অস্ত্র লুঠ, সাম্প্রতিক কালে পার্থ-সৌম্যজিতের অপহরণ ও খুনের অভিযোগ-সহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে রাজারামের নামে। তিনি ১৯৯৮-এর আগে সিপিএমের সমর্থক ছিলেন বলে পুলিশ সূত্রের দাবি।
আর বান্দোয়ানে সিপিএমের পুরুলিয়া জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন্দ্রনাথ কর ও তাঁর স্ত্রীকে খুন, শিলদায় ইএফআর ক্যাম্পে হামলা বা সাঁকরাইল থানায় ঢুকে পুলিশকর্মীদের খুন ও অপহরণ-সহ অন্তত ৭টি বড় মামলা রয়েছে ২৭ বছরের জাগরীর বিরুদ্ধে। ঝাড়খণ্ডের দলমা স্কোয়াডেও একদা এই দু’জন জড়িত ছিলেন। সেখানেও তাদের নামে কিছু অভিযোগ রয়েছে। এই দুই ‘ডাকাবুকো’ মাওবাদী জঙ্গির ‘পরিবর্তনে’ দৃশ্যতই খুশি মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, “আমি ওদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি চাই, ওরা ভাল থাকুক। ওদের যে সমস্ত মামলা রয়েছে, তা আমরা খতিয়ে দেখছি। ওদের ঘর বাঁধার জন্য আমরা সব রকম সাহায্য করব।”
পুলিশ সূত্রের খবর, মাসখানেক ধরেই কয়েকটি সূত্রের মাধ্যমে জাগরীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছিল। মাস দেড়েক আগে বেলপাহাড়িতে ধৃত জঙ্গি গুরুচরণ কিস্কু ওরফে মার্শালের ধরা পড়া এবং ১০-১২ দিন আগে অযোধ্যা স্কোয়াডের ‘বিস্ফোরক-বিশেষজ্ঞ’ দুর্যোধন রাজোয়ার ও তাঁর স্ত্রী আকরি সহিসের ‘আত্মসমর্পণে’র পরেই জাগরী-রাজারামের মূল স্রোতে ফেরার ‘ইচ্ছা’র বিষয়ে পুলিশ ওয়াকিবহাল হয়। একটানা জঙ্গি-জীবনের ক্লান্তি ও পুলিশি অভিযানের তীব্রতার ফলেও এই দম্পতি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছিলেন বলে মনে করে পুলিশের একাংশ। পুরুলিয়া থেকেই তাঁদের কলকাতায় নিয়ে আসে পুলিশ।
জাগরী এবং তাঁর স্বামী রাজারাম এ দিন আনুষ্ঠানিক ভাবে কলকাতায় রাজ্যের আইজি (আইবি) ওমপ্রকাশ গুপ্তের সামনে আত্মসমর্পণ করেন। জঙ্গি দম্পতি এবং তাদের ছেলে বাহাদুরকে এর পরে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়। মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের পিছনের দরজা দিয়ে মহাকরণে তাঁর ঘরে ঢোকে এই পরিবার। সেখানে মিনিট পনেরো তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী। এর পরেই মাওবাদী দম্পতি-সহ রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়, এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ এবং আইজি (আইবি) ওমপ্রকাশকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে জাগরী বাস্কে ও রাজারাম সোরেন। রয়েছে তাঁদের ছেলে বাহাদুরও। ছবি: দেবাশিস রায়
রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষ বলেন, “সরকার ওঁদের সব রকম সাহায্য করবে। আশা করব, অন্য জঙ্গিরাও এই দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হবেন।” এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) বলেন, “জাগরী, তাঁর স্বামী রাজারাম ও তাঁদের পুত্রকে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখার ব্যবস্থা পুলিশ করবে।” তবে জাগরীদের নিরাপত্তার স্বার্থেই এর বেশি বলতে চাননি পুলিশ-কর্তারা।
প্রশাসনিক ‘সাফল্যে’র পাশাপাশি দুই মাওবাদী স্কোয়াড নেতা-নেত্রীর আত্মসমর্পণে ‘রাজনৈতিক ফায়দা’ও পেয়েছেন মমতা। বিশেষত, এমন একটা সময়ে, যখন জ্ঞানেশ্বরী-কাণ্ড নিয়ে তাঁকে বিরোধীরা চেপে ধরেছে! জাগরী ও রাজারামের আত্মসমর্পণের ঘটনাকে স্বাগত জানিয়েছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিএম। তাদের মতে, রাজ্যের পক্ষে এই ঘটনা ‘গুরুত্বপূর্ণ’।
বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন বলেন, “দু’জন আত্মসমর্পণ করেছেন, খুব ভাল কথা। এই ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের নীতি আছে। সে সব মেনেই আত্মসমর্পণ হয়েছে। মাওবাদী সমস্যা কোনও একটা রাজ্যের ব্যাপার নয়। গোটা দেশের সমস্যা। কিন্তু দু’জন আত্মসমর্পণ করেছে, এটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।” বামফ্রন্ট জমানাতেই মাওবাদীদের জন্য আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।
কয়েক জন আত্মসমর্পণ করেওছিলেন। সেই প্রক্রিয়াই নতুন সরকারের আমলে অব্যাহত রয়েছে বলে সিপিএমের বক্তব্য। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সূর্যবাবু বলেন, “এর ফলেই মাওবাদী সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে, মনে করার কারণ নেই। আর মাওবাদীরা উৎসাহিত হবেন, কী করবেন, বলা মুশকিল! দেশে মাওবাদী সমস্যা ও হিংসা চললে পশ্চিমবঙ্গ তো বিচ্ছিন্ন শান্তির দ্বীপ হয়ে থাকতে পারে না। তবে রাজ্যে দু’জন আত্মসমর্পণ করেছেন, এটা ভাল কথা।”
আদতে ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলার পটমডার বাসিন্দা জাগরী। পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ির বকডোবা গ্রামে থাকার সময়েই তাঁর জঙ্গিদের সংস্পর্শে আসা। রাজারাম বাঁকুড়ার রানিবাঁধ থানার মিঠাআম গ্রামের যুবক। রাজারাম এ দিন বলেন, “লেখাপড়া জানি না। পিছিয়ে-পড়া এলাকায় বড় হয়েছি। ওরা বলেছিল, আদিবাসীদের উন্নয়ন করবে। কিন্তু যখন দেখলাম, ওরা আদিবাসীদেরই মারছে, তখন ভুল বুঝতে পারলাম। বুঝলাম, অন্যায় হচ্ছে। তাই ফিরে এলাম।” জাগরীর কথায়, “পার্টি আমাদের ভুল পথে নিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, মানুষকে স্বাধীনতা দেব। ওরাই আমাদের বন্দুক চালাতে শিখিয়েছে। মানুষ মারতে শিখিয়েছে, পুলিশ মারতে শিখিয়েছে। ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম, ওরা অনেক অন্যায় করছে। উন্নয়নেরই বিরোধিতা করছে। তখনই ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিই।”
দুই মাওবাদী নেতার ‘পুনর্বাসনে’ সাহায্যের আশ্বাস দেওয়ার পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ওদের বাচ্চাটা খুব ভাল, বুদ্ধিমান। নাম বাহাদুর, কাজেও বাহাদুর। আমরা ওকে সুন্দর করে মানুষ করতে চাই। ওকে রামকৃষ্ণ মিশনের কোনও স্কুলে ভর্তি করানোর চেষ্টা করছি। না হলে হস্টেল আছে, এমন কোনও ভাল স্কুলে আমরা ওকে বারো ক্লাস পর্যন্ত পড়িয়ে সুন্দর করে মানুষ করব।” জাগরীদের সঙ্গে কী কথা হয়েছে, তা উল্লেখ করতে গিয়ে মমতা বলেন, “আমার সঙ্গে ওদের কিছু কিছু কথা হয়েছে। ওরা আমাকে জানিয়েছে, কী ভাবে মাওবাদীরা অত্যাচার করে, গরিব মানুষকে খুন করে, লুঠ করে।” এর পরেই মাওবাদীদের ‘ভাই-বোন’ বলে সম্বোধন করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “রক্তের রাজনীতি ছেড়ে, খুনের রাজনীতি ছেড়ে ভাই-বোনেরা বেরিয়ে আসুক। ওদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। খুন-খারাবি বন্ধ হোক।” জাগরী-রাজারাম ধরা দিলেও পুরুলিয়ার অযোধ্যায় পাহাড়ের প্ল্যাটুনে রঞ্জিত পাল, বিক্রমের মতো জঙ্গি নেতারা এখনও ‘সক্রিয়’ বলে জানাচ্ছে পুলিশ। মাওবাদীদের ‘মদতদাতা’দের এ দিনও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, “আমি বলব, সত্যিই যদি আপনারা মানুষকে ভালবাসেন, চক্রান্ত বন্ধ করুন। মাওবাদী, সিপিএম, কংগ্রেস, তৃণমূল, যে কোনও দলের কর্মীর মৃত্যুই দুঃখের। আদর্শগত লড়াই হোক, খুনোখুনি বন্ধ হোক।” তবে জঙ্গলমহলে নতুন করে অভিযান শুরু করলেও তিনি যে শান্তি জারি রাখতেই আগ্রহী, তা আরও এক বার স্পষ্ট করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। শান্তি প্রক্রিয়া কি চলবে? জবাবে মমতা বলেন, “শান্তি একটা নিরবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। শান্তির বিপরীত কথা অশান্তি। মনে রাখতে হবে, অশান্তি করে শান্তি হয় না।”
এমতাবস্থায় জঙ্গলমহল ও ডুয়ার্সের উন্নয়নে পঞ্চম তফসিলকে রাজ্যের পঞ্চায়েত আইনের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছেন কংগ্রেস বিধায়ক দেবপ্রসাদ রায়। তিনি বলেন, “পঞ্চম তফসিলের ধারাগুলিকে রাজ্যের পঞ্চায়েত আইনে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য রাজ্য সরকারকে প্রস্তাব দেব আগামী বিধানসভা অধিবেশনে। এর মাধ্যমে জল-জমি-জঙ্গলের যাবতীয় অধিকার এলাকার মানুষের হাতে দিয়ে উন্নয়নের কাজে তাঁদেরও অংশীদার করা যাবে বলে মনে করি।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.