ঘরের মাঠে পঁচাত্তরতম টেস্ট জয় চার দিনেই
পরিবর্তনের ইডেনে উজ্জ্বল পরিবর্তনের ভারতীয় ক্রিকেট
ক দিকে চার দিনে পঁচাত্তরতম টেস্ট জয় ছিনিয়ে নেওয়ার উজ্জ্বল আবহ। অন্য দিকে মাঠের বাইরে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি যুবরাজ সিংহের তৃতীয় টেস্ট থেকে বাদ পড়া নিয়ে।
ধোনিদের ইডেন-জয়ের পর যত সময় যাচ্ছে তত উৎসবের রেশ কমছে। যুবরাজের বাদ পড়া নিয়ে জল্পনা বাড়ছে। রাতের দিকে টিম হোটেলে গিয়ে দেখা গেল, একদম শুনশান করছে। চার দিন ধরে খালি পড়ে থাকা ইডেন এই নিস্তব্ধতার পাশে কিছুই না। দেখে মনেই হবে না কয়েক ঘণ্টা আগে ধোনিরা ২-০ সিরিজ জয় সম্পন্ন করে উঠেছেন।
কিন্তু ওই নীরবতার মধ্যেও যুবরাজ নিয়ে নানা গুঞ্জন বেরিয়ে পড়ছে। জাতীয় নির্বাচকেরা কি বাঁ হাতি ব্যাটসম্যানের মুখের উপর টেস্টের দরজা চিরতরে বন্ধ করে দিলেন? মুম্বইয়ের শেষ টেস্টের জন্য যুবরাজের জায়গায় নেওয়া হয়েছে রোহিত শর্মাকে। কিন্তু প্রথম একাদশে তাঁর বদলি হতে যাচ্ছেন বিরাট কোহলি। ধরে নেওয়া হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া সফরে হরভজন সিংহের মতোই যাওয়া হচ্ছে না যুবরাজের। হরভজনের সঙ্গে পঞ্জাবের হয়ে রঞ্জি খেলে বেড়াতে হবে তাঁকে।
কিন্তু তার চেয়েও যেটা চাঞ্চল্যকর, টিম ম্যানেজমেন্ট নাকি যুবরাজের সমর্থনে কিছু বলেনি। উল্টে নাকি আভাস-ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, যুবরাজ পুরো ফিট নন। টিমের কয়েক জন সিনিয়র ক্রিকেটারও জানতেন না জেতার পরেও কোনও পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু নির্বাচকেরা মোটামুটি একমত ছিলেন বাদ দেওয়ার ব্যাপারে। যেখানে ৩৯ বছরের রাহুল দ্রাবিড় দুর্দান্ত ক্যাচ নিলেন এক হাতে ডান দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেখানে ইডেন-টেস্টে যুবরাজের খারাপ ফিল্ডিং ভীষণ ভাবে তাঁর বিরুদ্ধে গিয়েছে।
কয়েক ঘণ্টা আগে মাঠের দৃশ্যের সঙ্গে টিম ইন্ডিয়ার অন্দরমহলের এই ছবির কত তফাত! মাঠে যেমন পুরস্কার বিতরণীর সময় দেখা গেল সচিন তেন্ডুলকর দৌড়তে দৌড়তে ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে এলেন! মুখ্যমন্ত্রী অপেক্ষা করছেন যে! এইমাত্র চার দিনের মধ্যে ইনিংস এবং ১৫ রানে জয় সম্পন্ন করে উঠেছে ধোনির টিম। সচিন বেরিয়ে আসছেন দেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এগিয়ে এসে হাত মেলালেন। এমনই আন্তরিক আর আবেগ ভরা ছিল সেই শুভেচ্ছা বিনিময়ের দৃশ্য যে, ক্লাব হাউসের আপার টিয়ারে কেউ কেউ বলতে শুরু করল, “আরে, দিদি আদর করে সচিনের গাল টিপে দিল।”
খুশির ইডেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘিরে টিম-ধোনি। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
শোনা গেল, সচিনের সামনে জগমোহন ডালমিয়াকে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “আপনারা নাকি একশো সেঞ্চুরি করলে সচিনকে একশো গিনি দেবেন বলে ঠিক করেছিলেন? তা ওটা আবার রেখে দিচ্ছেন কেন? এখানেই দিয়ে দিতে পারতেন। ও তো পরের টেস্টেই সেঞ্চুরিটা করে দেবে।” একটু পরে আবার ধোনি এবং মমতার একসঙ্গে ছবি তোলার জন্য ভিড় করলেন চিত্রসাংবাদিকেরা। এক জন প্রাক্তন রেলমন্ত্রী। আর এক জন খড়গপুরে রেলকর্মী হিসেবে কাজ করতে করতে আজ ভারত অধিনায়ক। ধোনিকে বিয়ে এবং বিশ্বকাপ জেতার জন্য অভিনন্দন জানালেন মমতা।
টেস্ট এবং সিরিজ জয় সম্পন্ন করে উঠে এ দিনই মুম্বই রওনা হয়ে গেলেন সচিন। শেষ টেস্ট তাঁর নিজের শহরে। বিমানবন্দরের দিকে রওনা হওয়ার আগে তাঁকে জিজ্ঞেস করা গেল, দিদির সঙ্গে দেখা হওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন? সচিন বললেন, “ভাল। আগেও ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে। কলকাতাতেই একটা অনুষ্ঠানে দু’জনে ছিলাম।” জানেন কী, মাঠে জল্পনা চলছিল যে, দিদি নাকি আদর করে আপনার গাল টিপে দিয়েছে? সচিন হেসে ওঠেন, “আরে, না, না। সে রকম কিছু উনি করেননি।” তখনকার মতো দেখেশুনে মনে হচ্ছিল, পরিবর্তনের ইডেন। আর তার পাশাপাশি পরিবর্তনের ভারতীয় ক্রিকেট। চুম্বকে এটাই বৃহস্পতিবারের ইডেনের প্রধান সুর। পরিবর্তনের ইডেন দেখল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে পাল্টে যাওয়া সম্পর্ক। আর পরিবর্তনের ভারতীয় ক্রিকেট দেখল, দু’মাস আগে বিপর্যস্ত ক্রিকেটারদের পুনর্বাসন। ইংল্যান্ডে বিপর্যস্ত হয়ে ফেরার পর কী রকম অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল আজ পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে গেলে অবিশ্বাস্য মনে হবে। কেউ বিশ্বাস করবে যে, সিরিজ শুরুর আগে কট্টরপন্থী বলে পরিচিত অন্যতম নির্বাচক প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সিনিয়রদের ছাঁটাইয়ের কাজটা আসুন আমরা এখান থেকেই শুরু করি। আর কাজটা শুরু হোক ভিভিএস লক্ষ্মণকে দিয়ে। সেই লক্ষ্মণ যিনি কি না এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর সামনে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার নিয়ে গেলেন।
বৃহস্পতিবার শুরুর দিকটা অবশ্য যথেষ্ট উদ্বেগে কাটাতে হচ্ছিল ধোনিদের। ফলো অন করেও ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৬৩ তুলে ফেলল। সকালবেলা যখন উইকেট পড়ছে না, তখন মাঠের ভেতর ভারতীয় ক্রিকেটারদের দুর্বল শরীরী ভাষা। রবিচন্দ্রন অশ্বিন দু’ইনিংস মিলিয়ে চারটে উইকেট তুললেন। কিন্তু হরভজন সিংহের সেই আক্রমণাত্মক শরীরী ভাষা তাঁর কোথায়? বরং বাঁ-হাতি স্পিনার প্রজ্ঞান ওঝাকে ইডেন টেস্টে বেশি চনমনে লেগেছে। ম্যাচ থেকে ওঝার সংগ্রহও বেশি ছয় উইকেট।
বন্ধুর বিয়েতে যোগ দিতে হবে বলে হোটেলে ফিরেই ফ্লাইট ধরতে বেরিয়ে পড়লেন ওঝা। যাওয়ার আগে আনন্দবাজারকে জানিয়ে গেলেন, ম্যাচের স্মারক হিসেবে বলটা চেয়ে নিয়েছেন। “ইডেনে আমার প্রথম টেস্ট। টিম জিতেছে আর তাতে আমি সামান্য হলেও অবদান রাখতে পেরেছি। এই টেস্টে আমার পঞ্চাশ উইকেটও পূর্ণ হল। তাই বলটা আমি রাখতে চাই,” বললেন ওঝা।
বরং ইডেনের এই টেস্ট দু’দলের দুই তরুণ প্রতিভার আবির্ভাব হিসেবে চিহ্নিত থাকতে পারে। ভারতের উমেশ যাদব। জাভাগল শ্রীনাথের পর নিয়মিত ভাবে এত ফুটন্ত পেস বোলিং আর কেউ করতে পারেননি। চন্দ্রপল হলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্রাবিড়। সকাল থেকে এই উইকেটটার জন্যই সবথেকে বেশি প্রার্থনা ছিল। ব্রায়ান লারা সদৃশ ডারেন ব্র্যাভোকে নিয়ে চন্দ্রপল যখন দেওয়াল হয়ে উঠছেন, তখন যাদবই তাঁকে সরালেন। ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার বেগে ছিল বলটা। এ রকম গতি ইডেনের পিচেও হামেশা তুললেন। শেষ দৃশ্যটাও তিনি লিখলেন। পরপর দু’বলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের শেষ দুই উইকেট ফেলে।
ইডেনের ট্র্যাজিক নায়ক হিসেবে থেকে গেলেন ডারেন ব্র্যাভো। ২৩০ বলে ১৩৬ করেও যিনি ভবিতব্য ঠেকাতে পারলেন না। তাঁকে ডারেন ব্র্যাভো ডাকা হবে নাকি ‘ব্রায়ান লারা টু’ সেটা নিয়েই দেখলাম সবথেকে বেশি আলোচনা। সেঞ্চুরি করা মাত্র তাঁর সেলিব্রেশনের ভঙ্গি দেখে সঞ্জয় মঞ্জরেকর টুইট করলেন, “ব্র্যাভোর সেলিব্রেশনটাও এমনকী লারার মতো!” ছুটে গিয়ে শূন্যে লাফিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে ছুড়ে দেওয়া। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে তুলনা টানা শুরু হয়ে গেল। ১২ টেস্ট থেকে ব্র্যাভোর এটা দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। মোট রান ৯৪১। গড় ৪৭.০৫। ১২ টেস্ট পর লারার একই পরিসংখ্যান ছিল।
ধোনির জন্য আবার জরুরি পরিসংখ্যান হচ্ছে, মুম্বই টেস্ট জিততে পারলে ইংল্যান্ড সফরের পাল্টা সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া যাবে। ওখানে ০-৮। এখানে ৮-০। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পাঁচ ম্যাচের ওয়ান ডে সিরিজে ৫-০। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তিন টেস্টের সিরিজে ৩-০। বিকেলে মাঠ থেকে হোটেলে ফেরার পর এক জন এসে তাঁকে একটা ছবি উপহার দিলেন। ধোনি বলে ফেললেন, “বাহ্! এই ছবিটা আমি শ্বশুরবাড়িতে রেখে যাব।” বোঝাই যাচ্ছে, কী রকম ফুরফুরে মেজাজে আছেন তিনি। ইংল্যান্ডের সেই বিধ্বস্ত, আতঙ্কগ্রস্ত চোখমুখ থাকার কোনও প্রশ্ন নেই। ‘দিদি’-কে কী বলতে পারতেন ধোনি? যে, লন্ডন চাই না, কলকাতাই রাখুন?

যুবরাজকে বাদই দিলেন নির্বাচকেরা
প্রশ্ন ছিল একটাই। মুম্বই টেস্টের প্রথম এগারোয় যুবরাজ সিংহের থাকা উচিত কি না। মুম্বই পর্যন্ত যেতে হল না। কলকাতাতেই সে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলেন নির্বাচকেরা। যুবরাজকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সিরিজের শেষ টেস্টে বাদ দিয়ে। মুম্বই টেস্টের জন্য ভারতের যে দল এ দিন বেছে নিলেন নির্বাচকেরা তাতে জায়গা হয়নি যুবরাজের। দলে ফিরিয়ে আনা হল রোহিত শর্মাকে। এ ছাড়া বাকি দল অপরিবর্তই রইল। ফলে আবার বাইরে থাকতে হচ্ছে হরভজন সিংহকে। যুবরাজ বাইরে চলে যাওয়া মানে ধোনির দলের ছ’নম্বর জায়গা ফাঁকা হয়ে যাওয়া। সেই জায়গার জন্য এ বার প্রধান দাবিদার বিরাট কোহলি।

ম্যাচের স্কোর

ভারত
প্রথম ইনিংস: ৬৩১-৭ ডিঃ


ওয়েস্ট ইন্ডিজ
প্রথম ইনিংস: ১৫৩

ওয়েস্ট ইন্ডিজ
দ্বিতীয় ইনিংস (আগের দিন ১৯৫-৩)
ব্র্যাভো ক দ্রাবিড় বো প্রজ্ঞান ১৩৬
চন্দ্রপল বো উমেশ ৪৭
স্যামুয়েলস এলবিডব্লিউ অশ্বিন ৮৪
বাও ক দ্রাবিড় বো প্রজ্ঞান ৩
স্যামি বো উমেশ ৩২
রোচ বো অশ্বিন ১
ফিডেল এডওয়ার্ডস নঃআঃ ১৫
বিশু বো উমেশ ০
অতিরিক্ত ১৪
মোট ৪৬৩।
পতন: ২৩, ১১৬, ১৬১, ২৬৯, ৪০১, ৪১১, ৪১৭, ৪২১, ৪৬৩।
বোলিং: উমেশ ১৭.৩-১-৮০-৪, ইশান্ত ২৫-৪-৯৫-২, প্রজ্ঞান ৩২-৫-১০৪-২,
অশ্বিন ৪০-৪-১৩৭-২, যুবরাজ ৩-০-১৪-০, সহবাগ ৯-২-২০-০।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.