|
|
|
|
অচলাবস্থা চলছেই, উন্নয়ন গতিহীন আরামবাগে |
পীযূষ নন্দী • আরামবাগ |
রাজনৈতিক অস্থিরতা তো আছেই, প্রশাসনের গাফিলতির অভিযোগও উঠতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে বহু কোটি
টাকা অব্যবহৃত আরামবাগের পঞ্চায়েতগুলিতে। তা নিয়েই আনন্দবাজারের প্রতিবেদন। আজ প্রথম কিস্তি। |
আছেন কেমন? কাজকর্ম কেমন হচ্ছে পঞ্চায়েতে? কথা হচ্ছিল খানাকুল ২ ব্লকের মাড়োখানা গ্রামের বাসিন্দা কাজি আসগার আলি, মাসুদ আলি, শেখ ইনতিয়াজ সুফল মাইতি, গণেশ সাঁতরাদের সঙ্গে। সুফলবাবু জানালেন, একশো দিনের কাজ তবু একটু-আধটু হয়েছে। তা-ও যৎসামান্য। কিন্তু তা বাদে যাঁদের জমিজমা নেই, গ্রামে তাঁদের উপার্জনের আর কোনও পথ নেই। পঞ্চায়েতের আর কোনও প্রকল্প তো চোখেই পড়ে না।
আসগার জানান, বন্যার জন্য এই চত্বরে আমন ধান হয় না। টাকার অভাবে আলুচাষ করতে পারেননি। সারের দাম লাগামছাড়া। এই পরিস্থিতিতে বন্যায় ক্ষতিপূরণের টাকা এখনও পাননি। সংসার চালানো দায়।
ইনতিয়াজের কথায়, “গ্রামোন্নয়নে পঞ্চায়েত যা কাজ করছিল, গত কয়েক মাসে সে সব উধাও।”
খানাকুল ১ ব্লকের বালিপুর কিংবা ঘোষপুর গ্রামের দিনমজুর কার্তিক সামন্ত, শ্রীপদ মাইতিদের অভিযোগ, পঞ্চায়েতে কোনও পরিষেবাই পাওয়া যাচ্ছে না। কার্তিকবাবু বলেন, “পঞ্চায়েত ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করেছিল, ভূমিহীন কৃষি শ্রমিকদের ভবিষ্যনিধি প্রকল্পে আনা হবে। আম আদমি বিমা যোজনার সুবিধা দেওয়া হবেও বলেছিল। কিন্তু কোথায় কী!” গ্রামের লোকের বক্তব্য, পঞ্চায়েতে গেলে ‘শ্মশান’ মনে হয়। দু’এক জন কর্মী ছাড়া কেউ কোথাও নেই। কাজ হবে না জেনে গ্রামের লোকও আসা ছেড়ে দিয়েছেন।
পুড়শুড়া ব্লকের ভাঙামোড়া পঞ্চায়েতের সাহাপুর গ্রামের কিংশুক পাল, রতন মণ্ডল, শিবাণী রায়দের বক্তব্য, “সার্বিক স্বাস্থ্যবিধান অভিযানের আওতায় গ্রামে কিছু কাজ হয়েছিল। তারপর আর তদারকি হয়নি। যত্রতত্র নোংরা আবর্জনা, মলমূত্র পড়ে। গ্রামের একেবারে নরক-দশা!”
আরামবাগের বাতানল পঞ্চায়েতের ভালিয়া গ্রামে দুঃস্থ বৃদ্ধ শ্যামাপদ বাগের জিজ্ঞাসা, “বিপিএল তালিকায় আমার নাম উঠছে না কেন? বার্ধক্য ভাতা কি আর পাবই না?” গোঘাট ১ ব্লকের কুমুড়শা পঞ্চায়েতের মথুরা গ্রামের বাসিন্দা সুখলাল ধাড়ার অভিযোগ, এসডিও, পুলিশ সকলে এসে খালি চোলাইয়ের ভাঁটি ভেঙে দিয়ে যাচ্ছে। বিকল্প উপাজর্নের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কোথায় কী! তাঁর বক্তব্য, “গ্রাম স্বরোজগার যোজনার গোষ্ঠীগুলিকে একটু তদারক করে কার্যকর করা হলে বেশ সুরাহা হত।’’
গোঘাট ২ ব্লকের কুমারগঞ্জ পঞ্চায়েতের পুন্ডহিত গ্রামের কাকলি রায় নামে গৃহবধূ আবার আশা কর্মী এবং আইসিডিএস কর্মী নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ করলেন।
আরামবাগ মহকুমার ৬টি ব্লকের ৬৩টি পঞ্চায়েতের সব ক’টিই বামফ্রন্ট পরিচালিত। দীর্ঘ দিন ধরে রাজনৈতিক ডামাডোলের জেরে বেশির ভাগ পঞ্চায়েতের স্বাভাবিক কাজকর্ম কার্যত স্তব্ধ হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ। আগে ছিল সিপিএম-তৃণমূলের লড়াই। বিধানসভা ভোটের পর থেকে আবার তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেও ভুগতে হচ্ছে গ্রামবাসীকে। সব মিলিয়ে একশো দিনের প্রকল্প তো গতি পায়ইনি। অন্যান্য পরিষেবার অবস্থাও তথৈবচ।
সমস্যার কথা মেনে নিয়েছেন রাজনৈতিক দলের নেতা থেকে শুরু করে প্রশাসনের আধিকারিক সকলেই। একাধিক বার সর্বদল বৈঠক ডেকে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। বহু বেশির ভাগ প্রধান, পঞ্চায়েত সদস্যেরা অফিসে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। অনেকে কাজে ফিরলেও বাম পরিচালিত পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতি থেকে এখনও পদত্যাগের হিড়িক চলছে। আরামবাগের মহকুমাশাসক অরিন্দম নিয়োগী বলেন, “বিশেষ করে খানাকুলের দু’টি ব্লক এবং গোঘাটের দু’টি ব্লকের পঞ্চায়েতে সদস্যেরা পঞ্চায়েত অফিসে আসছেন না। আরামবাগ এবং পুড়শুড়া ব্লকের পঞ্চায়েতগুলিতে তাঁরা অনিয়মিত আসেন। তবে কয়েকটি পঞ্চায়েত ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রধানেরা আসছেন।” কিন্তু তাতেও যে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না, সে কথা জানিয়েছেন মহকুমাশাসক। কারণ, যেখানে প্রধান-উপপ্রধানেরা আসছেন, সেখানেও অনেক ক্ষেত্রে পঞ্চায়েত সদস্যেরা হাজির না হওয়ায় সাধারণ সভা ডাকা যাচ্ছে না। পঞ্চায়েত আইন অনুযায়ী, সাধারণ সভা ডেকে তবেই টাকা খরচ করা যায়।
আরও সমস্যা আছে। মহকুমাশাসক জানান, কোথাও হয়তো সদস্যদের কোনও মতে হাজির করে সাধারণ সভা ডাকা গেল। কিন্তু কিছু লোক প্রকল্প রূপায়ণে কোন কাজ আগে করতে হবে, কোন কাজ পরে তা নিয়ে হইচই বাধায়। সব মিলিয়ে একশো দিনের প্রকল্প ছাড়া আর কোনও কাজই তেমন এগোচ্ছে না। যদিও গোটা হুগলি জেলায় একশো দিনের প্রকল্পের যে খুবই খারাপ হাল, সে কথাও মানছেন প্রশাসনের কর্তারা। সমস্যা মেটাতে গ্রাম-স্তরে উন্নয়নে বিধায়কদের হস্তক্ষেপের ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মহকুমাশাসক। প্রতিটি সংসদে সর্বদল কমিটি গড়া হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন খাতে বহু কোটি টাকা পড়ে আছে বিভিন্ন পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিতে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই নির্দেশ দিয়ে জানিয়েছেন, প্রকল্পে পড়ে থাকা টাকা দ্রুত খরচ করতে হবে। কিন্তু আরামবাগ মহকুমার ক্ষেত্রে তা কতটা বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে প্রশাসনিক মহলেই। কত টাকা অব্যবহৃত আছে পঞ্চায়েতগুলিতে? |
|
|
|
|
|