সরকারি ভাবে তাঁদের দালাল বা ফড়ে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এই অভিযোগে চাষিদের কাছ থেকে ধান কেনা বন্ধ করে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ধান্য ব্যবসায়ী সমিতি। ইতিমধ্যেই বীরভূম ও বর্ধমানে বন্ধ হয়েছে ধান কেনা। বুধবার, ১৬ নভেম্বর থেকে তা ছড়িয়ে পড়ল গোটা রাজ্যে। এই সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছে ধানের মিলগুলি। রাজ্যের খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক অবশ্য বলেন, “ধান ব্যবসায়ীদের কখনও ফড়ে বলা হয়নি। আমি নিজেই চাষি পরিবারের ছেলে। এ সব আমার অজানা নয়। কিন্তু কিছু লোক বহু বছর ধরে দালালি করে আসছে। সরকার তাদের বরদাস্ত করবে না।”
জমি থেকে ধান ওঠার পরে চাষিরা প্রথমে নিজেদের খামারে ধানঝারার কাজ করেন। নতুন ধান কেউ কেউ ঝারার পরেই বিক্রি করেন। কেউ কেউ আবার গোলা কিংবা মরাইয়ে সেই ধান মজুত করে রাখেন। চাষিদের থেকে ধান কেনেন এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। এঁদের কাছে থাকে ট্রাক্টর, ধান মাপার যন্ত্র, শ্রমিক ইত্যাদি। চাষিদের থেকে কেনা ধান তাঁরা বিক্রি করেন বিভিন্ন মিলে। এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত অনেকেই বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ধান্য ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য। বৃহস্পতিবার মন্তেশ্বরের মালডাঙা শাখার একটি বৈঠকে হাজির ছিলেন বর্ধমান জেলা কমিটির সম্পাদক তথা রাজ্য কমিটির আহ্বায়ক প্রশান্ত লাহা, জেলা কমিটির সহ-সম্পাদক সুকান্ত পাঁজা-সহ বেশ কয়েক জন। প্রশান্তবাবুর অভিযোগ, “চলতি মরসুমে ধানের দাম অত্যন্ত কমে যাওয়ায় সরকারি ভাবে ধান কেনা শুরু হয়েছে। তবে ধান কেনার আগে খাদ্য দফতর আমাদের দালাল বলে অবিহিত করেছে। দীর্ঘদিন ধরে গ্রামে-গঞ্জে ধান কেনার সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা মর্মাহত। এই আচরণের প্রতিবাদেই কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংগঠন।” হুগলি, বাঁকুড়া, বর্ধমান এবং পুরুলিয়ার মতো চার জেলার সংগঠনের দায়িত্বে থাকা প্রশান্তবাবুর দাবি, “বীরভূমে ৯ নভেম্বর এবং ১৪ নভেম্বর বর্ধমানে কর্মবিরতি শুরু হয়েছে।”
এ ছাড়াও ব্যবসায়ীদের সরকারি স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের দাবি, মিলের মাধ্যমে নয়, বরং ব্যবসায়ীদের মাধ্যমেই চাষিদের কাছ থেকে সরকারি ভাবে ধান কিনুক সরকার। মালডাঙা শাখার সম্পাদক তথা বর্ধমান জেলার সহ-সম্পাদক সুকান্ত পাঁজা জানান, এক এক জন ধান ব্যবসায়ীর সঙ্গে যুক্ত পনেরো থেকে কুড়ি জন শ্রমিক। তাঁরা মূলত ধান ওজন, ধানের বস্তা ওঠানো-নামানোর কাজ করেন। ব্যবসায়ীরা অধিকাংশই শিক্ষিত যুবক। তাঁরা সারা বছর চাষিদের দাদন দিয়ে চাষাবাদের কাজে সাহায্য করেন। তাঁর দাবি, রাজ্যে ছোট-বড় সব ধরনের ধান ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের পরিমাণ ১৬০০ কোটি টাকা। সেই টাকাই দিনের পর দিন আটকে থাকে মিল মালিকদের কাছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে জ্যোতিপ্রিয়বাবুর দাবি, “ধান ব্যবসায়ীরা তাঁদের সমস্যা নিয়ে আমার কাছে কখনও আসেননি। ওঁদের উচিত ছিল, এ সব নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করা।”
এ দিকে, ব্যবসায়ীদের কর্মবিরতি শুরু হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন মিল মালিকেরা। কালনা শহর ঘেঁষা একটি রাইস মিলের মালিক শিবাশিস হালদার বরলেন, “দিন পাঁচেক ধরে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঠিক মতো জোগান মিলছে না। যা মজুত ছিল, তাও প্রায় শেষ। এর পরে মিলে ধান না এলে মেশিন বন্ধ করে দিতে হবে।” গোটা ঘটনায় বিভ্রান্ত চাষিরা। ধানচাষি রমেশ সরখেলের কথায়, “শুনেছি, সরকার সর্বোচ্চ ১৫ বস্তা ধান কিনবে। পাঁচ বিঘা জমিতে চাষ রয়েছে। ব্যবসায়ীরা ধান না কিনলে বাকি ধান বিক্রি করব কোথায়?” কর্মবিরতিতে সবথেকে বেশি সঙ্কটের মুখে প্রান্তিক চাষিরা। কারণ, তাঁদের অনেকেই এই ধান বিক্রি করে রবি মরসুমে চাষের সার-সহ নানা সরঞ্জাম কেনেন। |