ব্যাঙ্কে লুঠপাট শেষ করে ‘কিছু ক্ষণ’-এর মধ্যেই বোমা ফাটবে বলে হুমকি দিয়ে পালিয়েছিল ডাকাতদল।
সঙ্গে সঙ্গেই খবর যায় সিআইডি-র বম্ব স্কোয়াডে। বোমা নিষ্ক্রিয় করতে রাজ্য গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষজ্ঞেরা নদিয়ার সেই ব্যাঙ্কে পৌঁছলেন কখন?
ঝাড়া ৫০ ঘণ্টা পরে!
এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এমন ঘটনা ঘটছে বারে বারেই। কখনও বোমার খবর আসার দু’দিন পরে ঘটনাস্থলে যাচ্ছে বম্ব স্কোয়াড। কখনও বা উপযুক্ত সতর্কতা ছাড়াই ল্যান্ডমাইন নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে মারা
যাচ্ছেন পুলিশকর্মী। কয়েক বছর আগে ঝিটকার জঙ্গলে যা ঘটেছে। বা সদ্য যেমনটি ঘটে গেল নানুরে।
বম্ব স্কোয়াডের এই হাল কেন?
সিআইডি সূত্রের খবর, ভবানী ভবনের বম্ব স্কোয়াড কার্যত নিধিরাম সর্দার। উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই। লোকবল নেই। নেই নিজস্ব গাড়ি। নেই তালিম দেওয়া পুলিশ-কুকুরও। অথচ রাজ্যের ১৯টি জেলার কোথাও বোমা নিষ্ক্রিয় করতে ভরসা সবেধন নীলমণি
ওই বিভাগটিই। |
পরিকাঠামোর এই দৈন্যদশার সঙ্গে যোগ হয়েছে বাহিনীর সদস্যদের ‘বঞ্চিত’ হওয়ার ‘ক্ষোভ’। ভবানী ভবনে কর্মরত এক সাব-ইনস্পেক্টরের কথায়, “বাম জমানায় ভূপিন্দর সিংহ ডিজি থাকাকালীন আমাদের জন্য ৩০ শতাংশ ঝুঁকি-ভাতা চালু করার কথা বলেছিলেন। কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স এই ভাতা আদায় করে নিয়েছে। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা সত্ত্বেও সিআইডি-র বম্ব স্কোয়াডের ভাগ্যে কিছুই জোটেনি।”
বাহিনীর ঢিলেঢালা দশার ছবিটাও পুলিশকর্মীদের কথাতেই স্পষ্ট। তাঁরা জানিয়েছেন, বোমার খবর ভবানী ভবনে পৌঁছনোর পরে ফোন যায় কলকাতা পুলিশের অধীন আলিপুর পুলিশ প্রশিক্ষণ স্কুলে পুলিশ-কুকুরের জন্য। ব্যারাকপুরের লাটবাগানে পুলিশ প্রশিক্ষণ কলেজের পুলিশ-কুকুরও ব্যবহার করা হয়। মাওবাদী দমন অভিযান শুরু হওয়ার পরে দুর্গাপুরে এবং পুরুলিয়ার বলরামপুরেও কিছু তালিমপ্রাপ্ত কুকুর আনা হয়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তারা কাজে লাগলেও প্রয়োজনের তুলনায় এই সহায়তা যথেষ্ট নয়।
চটজলদি বোমা শনাক্ত বা নিষ্ক্রিয় করতে যাওয়ার পথে সময়মতো গাড়ি মেলে না। এটাও একটা বড় সমস্যা। এর জন্য লিখিত সুপারিশ করা হয় রাজ্য গোয়েন্দা বিভাগের কোনও বড়কর্তার কাছে। গাড়ি মিললেও যে চটপট রওনা হওয়া যাবে, এমন নয়। তখন খোঁজ পড়ে চালকের। চালক মিললে জোগাড় করতে হবে জ্বালানি তেল। এত সব ঝক্কি সামলে একটি গাড়িতে গাদাগাদি করে পুলিশ-কুকুর আর বোমা নিষ্ক্রিয় করার যন্ত্রপাতি নিয়ে বম্ব স্কোয়াডের জনাছয়েক কর্মী রওনা দেন ঘটনাস্থলে।সিআইডি সূত্রে জানা গিয়েছে, কলকাতা ছাড়াও শিলিগুড়িতে বম্ব স্কোয়াডের অফিস আছে। ইউনিট আছে পশ্চিম মেদিনীপুরে। তিনটি স্কোয়াডের কর্মী-সংখ্যা সব মিলিয়ে মাত্র ৩৫। মাওবাদী অধ্যুষিত পশ্চিম মেদিনীপুরে এই বিভাগে স্থায়ী ভাবে কোনও পুলিশকর্মীর সংস্থানই নেই। পর্যায়ক্রমে ভবানী ভবনের পুলিশকর্মীদেরই ওই তল্লাটে ‘ডিউটি’ করতে হয়। রাজ্যের ১৯টি জেলায় বোমা নিষ্ক্রিয় করতে ডাক পড়ে তাঁদেরই। অথচ এক জন ডিএসপি-র অধীনে ইনস্পেক্টর, সাব-ইনস্পেক্টর ও কনস্টেবলদের নিয়ে থাকার কথা অন্তত ১৩৩ জন পুলিশকর্মী। এর ৭০ শতাংশ পদই ফাঁকা পড়ে রয়েছে।
রাজ্যে সিআইডি-র বম্ব স্কোয়াডের পরিকাঠামো যে বেহাল, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও তা জানে। গত মে মাসে রাজ্যে বম্ব স্কোয়াডের উন্নয়নের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ পাঠিয়েছে কেন্দ্র। প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্যেরও আশ্বাস দিয়েছে তারা। পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি ওই নির্দেশ গিয়েছে বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, অন্ধ্রপ্রদেশ, জম্মু-কাশ্মীরেও। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, “বর্তমান পরিস্থিতিতে ওই সব রাজ্যে নাশকতার আশঙ্কা সব চেয়ে বেশি। তাই এই নির্দেশ জারি করা হয়েছে।”
বম্ব স্কোয়াডের পরিকাঠামো যে দুর্বল, তা স্বীকার করেছেন রাজ্যের সিআইডি ডিআইজি (অপারেশনস) কে জয়রামন। তিনি বলেন, “সিআইডি-র নিজস্ব ডগ স্কোয়াড তৈরির জন্য ঊধ্বর্র্তন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ গিয়েছে। গাড়িরও ব্যবস্থা হবে।” সিআইডি-র এক কর্তা বলেছেন, “দমকলের মতো গন্তব্যস্থলে দ্রুত পৌঁছতে হয় বম্ব স্কোয়াডকেও। তাই হুটার লাগানো একটি গাড়িও দরকার।” |