অভিযান শুরু হতেই চার মাস অস্ত্রবিরতির প্রস্তাব
বলরামপুরে পথ আটকে যৌথ বাহিনীর গুলি, হত দুই মাওবাদী
ঙ্গলমহলে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে ফের অভিযান শুরু করে দিল যৌথ বাহিনী। আর সরকার কড়া হচ্ছে বুঝেই সুর নরম করে চার মাস সংঘর্ষ বিরতির প্রস্তাব দিল মাওবাদীরা। যদিও সরকার সেই প্রস্তাবে সাড়া দেবে এমন ইঙ্গিত মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত নেই।
সোমবার রাতে বলরামপুরের এক তৃণমূল কর্মীর বাবা ও ভাইকে খুন করে পালানোর সময় মাওবাদীদের পথ আটকায় যৌথ বাহিনী। গুলির লড়াই চলে সারা রাত। তাতে দুই মাওবাদী স্কোয়াড সদস্যের মৃত্যু হয়। জখম হন বাহিনীর দুই জওয়ানও।
অযোধ্যা পাহাড়কে ‘লাশের পাহাড়’ হতে দেবেন না মাওবাদী হামলায় বলরামপুরের তৃণমূল কর্মী জিতু সিংহ হত্যার প্রতিবাদে আয়োজিত সভায় গিয়ে বলে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মাওবাদীরা রক্তপাত বন্ধ না করলে সরকার যৌথ বাহিনীর অভিযান চালু করতে বাধ্য হবে বলে হুঁশিয়ারিও দিচ্ছিলেন লাগাতার। সোমবার সন্ধ্যায় অযোধ্যা পাহাড় লাগোয়া খুনটাঁড় গ্রামের তৃণমূল কর্মী রাজেন সিংহ সর্দারের বাবা অজিত ও ভাই বাকুকে মাওবাদীরা গুলি করে মারার পরে সেই কাজই শুরু করে দিল যৌথ বাহিনী।
আর যৌথ বাহিনীর অভিযান নতুন করে শুরু হওয়ায় মাওবাদীরা যে যথেষ্ট চাপের মুখে, মঙ্গলবারই তার প্রমাণ মিলেছে। অস্ত্র সংবরণের মেয়াদ শেষ হল বলে ঘোষণা করার পরে একেবারে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে এ দিন তারা জানিয়েছে, যৌথ বাহিনীর অভিযান বন্ধ হলে চার মাসের জন্য অস্ত্র সংবরণে তারা রাজি। যে প্রস্তাবকে ‘পিছু হটা’ হিসেবেই দেখছে প্রশাসনের একাংশ।
আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) গঙ্গেশ্বর সিংহ এ দিন জানান, খুনটাঁড় গ্রামে হামলার খবর পেয়েই বলরামপুর থানার পুলিশ এবং পুরুলিয়ার দুই ডিএসপি-র নেতৃত্বে জেলা পুলিশের কমান্ডো বাহিনী, কোবরা ও নাগা বাহিনী আর সিআইএফ (কাউন্টার ইনসার্জেন্সি ফোর্স) দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। ঘাটবেড়া গ্রাম থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে মাওবাদীদের পালানোর সম্ভাব্য পথে ‘পজিশন’ নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন জওয়ানেরা। কোণঠাসা হয়েছে বুঝে মাওবাদীরা গুলি চালাতে শুরু করে। প্রত্যাঘাত করে যৌথ বাহিনী। সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে শুরু হওয়া গুলির লড়াই দফায় দফায় চলে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত।
ঘাটবেড়ার কাছে সংঘর্ষে হত মাওবাদীদের দেহ। নিজস্ব চিত্র
আইজি বলেন, “নিহতদের এক জন ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা বীরেন ওরফে বিদ্যুৎ। অন্য জন সুরেশ ওরফে সুবল। সে স্থানীয় যুবক। গুলির লড়াইয়ে ওই দুই মাওবাদী স্কোয়াড সদস্যের মৃত্যু ছাড়াও ওদের আরও কয়েক জন আহত হয়েছে।” তাঁর বক্তব্য, হামলায় রঞ্জিত পালের নেতৃত্বে মাওবাদীদের অযোধ্যা স্কোয়াডের ১৫-২০ জন ছিল। দলে মহিলাও ছিল। ঘটনাস্থল থেকে মহিলাদের চটি, ওড়না মিলেছে।
মাওবাদীদের কাছ থেকে একটি এসএলআর, ৯ এমএম পিস্তল, থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, দো-নলা বন্দুক এবং প্রায় ১৫০-২০০ রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার হয়েছে বলে আইজি দাবি করেছেন। পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার সুনীল কুমার চৌধুরী বলেন, “উদ্ধার হওয়া থ্রি নট থ্রি রাইফেলটি ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আড়শার কাঁটাডি পুলিশ ক্যাম্প থেকে লুঠ করেছিল মাওবাদীরা। ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারিতে বরাভূম স্টেশনে তিন আরপিএফ জওয়ানকে খুন করে অস্ত্র লুঠ করেছিল মাওবাদীরা। লুঠ হওয়া এসএলআরের মধ্যে একটি এ দিন মৃত মাওবাদীদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে।”
গত নভেম্বরেই পুরুলিয়ার কোটশিলায় যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে মৃত্যু হয় মাওবাদী স্কোয়াড সদস্য ধীরেন মুর্মু ওরফে রিমিল এবং আদিবাসী মূলবাসী জনগণের কমিটির মুখপাত্র বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ঠিক এক বছরের মাথায় সোমবার রাতে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযানে ফের ‘সাফল্য’ পেল যৌথ বাহিনী।
যৌথ বাহিনীর এই ‘সাফল্যের’ মাঝেই মাওবাদীদের তরফে সংঘর্ষবিরতির প্রস্তাব এসেছে সরকার নিযুক্ত মধ্যস্থতাকারীদের কাছে। মধ্যস্থতাকারী দলের সদস্য সুজাত ভদ্র এ দিন সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে জানিয়েছেন, সোমবার রাতেই তিনি মাওবাদীদের পক্ষ থেকে একটি চিঠি পান। তাতেই যৌথ বাহিনীর অভিযান বন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে চার মাসের জন্য অস্ত্র সংবরণের কথা বলা আছে। চিঠিতে ৬ নভেম্বর তারিখ রয়েছে। চুক্তি ভঙ্গের চিঠির তারিখ ছিল ৩১ অক্টোবর। অর্থাৎ চুক্তি ভঙ্গ করার চিঠি দেওয়ার ৭ দিন পরে মাওবাদীরা পুনরায় যৌথ বাহিনীর অভিযান বন্ধ করার আবেদন জানিয়ে মধ্যস্থতাকারীদের চিঠি দিয়েছে। রাজ্য প্রশাসনের একাংশের মতে, মুখ্যমন্ত্রী ‘কড়া’ মনোভাব নেওয়াতেই মাওবাদীরা কার্যত ‘পিছু হঠেছে’। পাশাপাশি, এর আগেও যে ভাবে ‘অস্ত্র সংবরণের’ কথা বলে যৌথ বাহিনীর অভিযান ঠেকিয়ে রেখে নিজেদের সংগঠিত করেছিল মাওবাদীরা, সেই কৌশলই তারা ফের নিতে চলেছে বলে রাজ্য সরকারের একাংশ মনে করছে। সুজাতবাবু অবশ্য জানিয়েছেন, মাওবাদীরা এখনও আলোচনা করতে রাজি আছে। তবে তাদের কিছু শর্তও রয়েছে।
রাজ্য সরকার যে মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকায় ‘সন্তুষ্ট’ নয়, তা মুখ্যমন্ত্রী নিজেই সুজাতবাবুদের ডেকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। মাওবাদীরা যে ভাবে একের পর এক তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের খুন করতে শুরু করেছে, তাতে স্পষ্ট, মুখ্যমন্ত্রী অভিযান বন্ধের নির্দেশ দেবেন না। এই পরিস্থিতিতে মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকা কী হবে, তা ঠিক করতে মঙ্গলবার রাতে সুজাতবাবুরা বৈঠকে বসেন। দীর্ঘ আলোচনার পরেও কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। আবার তাঁরা বৈঠকে বসবেন।
যৌথ অভিযানের পাশাপাশি মাওবাদীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রচারও অব্যাহত রাখছে তৃণমূল। যে রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্যই মাওবাদীরা শঙ্কিত বলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর। মাওবাদীদের হাতে মারা যাওয়া অজিত সিংহ সর্দার ও বাকুর দেহ এ দিনই কলকাতা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে দেহ দু’টি পিস হেভ্নে রাখা হবে। আজ, বুধবার বেলা ১১টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত গাঁধীমূর্তির পাদদেশে শায়িত থাকবে দু’জনের দেহ। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী-সহ তৃণমূল নেতারা শ্রদ্ধা জানাবেন।
সোমবার রাত থেকে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সময় নাগা বাহিনীর দুই জওয়ানও আহত হয়েছেন। এক দফা গুলির লড়াই থেমে যাওয়ার পরে জওয়ানরা যখন তল্লাশি চালাতে জঙ্গলে ঢোকেন, তখনই মাওবাদীদের গুলিতে আহত হন কাতো সেমা ও মাসিভিকো অঙ্গ নামে ওই দুই জওয়ান। তাঁদের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। মাথায় গুলির আঘাত লেগেছে মাসিভিকের। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক।
এ দিন বেলার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ে যৌথ বাহিনীকে নিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছেন সিআইএফ-এর এসপি মনোজ বর্মা। উপস্থিত রয়েছেন আইজি-ও। জখম কোনও মাওবাদী জঙ্গলে বা লাগোয়া গ্রামে লুকিয়ে আছে কি না, তা জানতে আদ্রার রেলরক্ষী বাহিনীর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া কুকুর নিয়ে আসে পুলিশ। পরে খেঁকড়িডি গ্রাম থেকে নবীন মুর্মু ও নেপাল মুর্মু নামে দুই আদিবাসী যুবককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ আটক করে। কুকুরটি মাটি শুঁকতে শুঁকতে তাঁদের বাড়ি গিয়েছিল।

সহ প্রতিবেদন: শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল

এই সংক্রান্ত অন্য খবর



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.