এক দিকে তিনি তৃণমূল কর্মী। অন্য দিকে সক্রিয় ভাবে যুক্ত ‘জঙ্গলমহল উন্নয়ন বিরোধী প্রতিরোধ কমিটি’-র সঙ্গেও।
বলরামপুরের খুনটাঁড় গ্রামের যুবক রাজেন সিংহ সর্দারের এই ‘দ্বৈত পরিচয়’-এরই মাসুল দিতে হল তাঁর বাবা ও ছোট ভাইকে। প্রাথমিক ভাবে এমনই মনে করছেন পুরুলিয়া জেলা পুলিশের কর্তারা ও জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব। সোমবার সন্ধ্যায় রাজেনকে না পেয়ে তাঁর বাবা, অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক স্কুল-শিক্ষক অজিত সিংহ সর্দার ও ভাই বাকুকে গুলি করে খুন করে মাওবাদীরা। আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) গঙ্গেশ্বর সিংহ মঙ্গলবার খুনটাঁড়ে দাঁড়িয়েই জানান, রাজেন এলাকায় মাওবাদী বিরোধী প্রচারের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণেই তাঁর বাড়িতে হামলা করে মাওবাদীরা।
বস্তুত, বাঁদনা উৎসবে সামিল হতে সোমবার সন্ধ্যাতেই বাড়ি ফিরেছিলেন বছর তিরিশের রাজেন। এক সময়ে আদিবাসী মূলবাসী কমিটির (প্রশাসনের মতে, যা মাওবাদীদেরই প্রকাশ্য সংগঠন) হয়ে সক্রিয় ভাবে কাজ করতেন রাজেন। তখন পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছিলেন। বর্তমানে তৃণমূলে যোগ দেওয়া এবং পরে মাওবাদীদের বিরুদ্ধাচারণ করা প্রতিরোধ কমিটির কাজ করতে গিয়েই মাওবাদীদের ‘বিষনজরে’ পড়েন এই যুবক। ঘটনা হল, প্রতিরোধ কমিটির হয়ে কাজ শুরু করার পর থেকেই ‘মাওবাদী হুমকি’-র জেরে গত কয়েক মাস ধরে বাড়িতে থাকছিলেন না রাজেন। কিন্তু বাঁদনা পরব উপলক্ষে তিনি যে বাড়ি ফিরবেন, সে খবর ছিল মাওবাদীদের কাছে। পরিকল্পনা করেই সোমবার তাঁকে মারতে বাড়িতে হামলা চালিয়েছিল মাওবাদীদের অযোধ্যা স্কোয়াডের জনা ১৫-২০ সদস্য। |
রাজেনের মা চারুবালা সিংহ সর্দার মঙ্গলবার বললেন, ‘ছেলেটাকেই মারতে এসেছিল মাওবাদীরা। না পেয়ে স্বামী আর ছোট ছেলেকে খুন করল। যাওয়ার আগে বলে গেল, এর পরেও রাজেন অঘোরের পার্টি (অঘোর হেমব্রমের নেতৃত্বাধীন প্রতিরোধ কমিটি) না ছাড়লে কেউই বাঁচবে না!”
সোমবারের ওই ঘটনার পরে আক্ষরিক অর্থেই স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ হারিয়ে ফেলেছে পরিবারটি। এ দিন সকালে খুনটাঁড় গ্রামের এক প্রান্তে অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশ লাগোয়া রাজেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, উঠোনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পরিবারের সদস্যেরা। সকলেই মহিলা। পুরুষ বলতে একমাত্র নিহত অজিতবাবুর বৃদ্ধ দাদা লক্ষ্মণ সিংহ সর্দার। বাঁদনা উপলক্ষে সোমবার এসেছিলেন অজিতবাবুর দশ ছেলেমেয়ে। রাজেনের দিদি কুমকুমদেবীর কথায়, “বাড়িতে পুজোর জন্যই বাবা সবাইকে ডেকেছিল বাড়িতে। ঝাড়খণ্ড থেকে এসেছিল বাকু। সব ভাইবোন আছে বলে বহুদিন পরে রাতে বাড়িতেই ছিল রাজেন।”
বাড়ির লোকেরা জানালেন, সামনের দিকের দেওয়াল টপকে ভিতরে ঢুকেছিল মাওবাদীদের কয়েক জন। তার আগে বাইরে থেকে অজিতবাবু আর বাকুর নাম ধরে ডেকে বারবারই প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে দরজা খুলতে বলেছিল। রাজেনের আর এক দিদি বিমলাদেবীর বিবরণ, “সন্ধ্যা হতেই সদর ও পিছনের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম ওদেরই ভয়ে। ডাকাডাকি শুনে বুঝে যাই, মাওবাদীরা এসেছে। তখন সবাই টিভি দেখছিলাম। রাজেন বিপদ বুঝে বেরিয়েই ছাদ টপকে বাড়ির পাশের দিকে পালায়।” তত ক্ষণে কয়েক জন মাওবাদী ভিতরে এসে সদর দরজা খুলতেই পুরো দলটা ঢুকে পড়ে ভিতরে। রাজেনের স্ত্রী রতিবালাদেবী বলেন, “ঢুকেই ওরা স্বামীর খোঁজ করে। ওঁকে না পেয়ে শ্বশুর আর দেওরকে বলে, ‘বহুবার বলেছি অঘোরের পার্টি করা চলবে না। রাজেন শুনছে না। তার শাস্তি তোদের পেতে হবে’।”
বন্দুকের কুঁদো দিয়ে বাড়ির মহিলাদের মারধর করার পরে মাওবাদীরা পিছনের দরজা দিয়ে টেনে নিয়ে যায় অজিতবাবু ও বাকুকে। অজিতবাবুর স্ত্রী চারুবালাদেবী বললেন, “ওদের নিয়ে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই পরপর কয়েক বার পটকা ফাটার মতো আওয়াজ পাই। তখনই বুঝে যাই, স্বামী আর ছেলেটাকে ওরা মেরে ফেলল।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, বাড়ির অদূরে মাঠের মধ্যে নিয়ে গিয়ে বাবা-ছেলেকে গুলি করে মারে মাওবাদীরা। রাতভর আতঙ্কে বাড়ির বাইরে বেরোননি কেউই। পরে পুলিশ গিয়ে দেহ উদ্ধার করে। চারুবালাদেবীর আক্ষেপ, “শেষ দেখাও দেখতে পেলাম না।” তবে আততায়ীদের দু’জনকে চিনতে পেরেছেন পরিবারের লোকেরা। এক জন কেরোয়া গ্রামের হলধর গরাই, অন্য জন ঘাটবেড়ার বিদ্যুৎ সিংহ সর্দার। চারুবালাদেবী বলেন, “হলধরই বেশি হম্বিতম্বি করে আমাদের ধমক দিচ্ছিল।” আইজি (পশ্চিমাঞ্চল)-ও জানিয়েছেন, হামলাকারীদের দলে ছিল মাওবাদী স্কোয়াড সদস্য হলধর। ওই রাতেই যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে মৃত হয় দুই মাওবাদীর। মৃতদের এক জনের নাম সুরেশ ওরফে বিদ্যুৎ। এই বিদ্যুৎ ঘাটবেড়ারই সেই বিদ্যুৎ সিংহ সর্দার কি না, তা অবশ্য পুলিশ নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি। আইজি বলেন, “আমরা মৃত মাওবাদীদের ছবি নিয়ে তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করব। তার পরেই নিশ্চিত ভাবে সব কিছু বলা সম্ভব।”
জোড়া খুনের পরে কি এলাকায় মাওবাদী প্রতিরোধের আন্দোলন গতি হারাবে? মঙ্গলবার বাবা ও ভাইয়ের মরদেহ নিয়ে কলকাতায় যাওয়ার আগে রাজেনের জবাব, “মাওবাদীদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করার অনেক বড় মাসুল দিতে হয়েছে বাবা আর ভাইকে হারিয়ে। তবে ওদের বিরুদ্ধে আন্দোলন বন্ধ করার প্রশ্নই ওঠে না! এলাকার মানুষ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। মাওবাদীদের এই হত্যার রাজনীতি বরদাস্ত করব না।” আর প্রতিরোধ কমিটি তথা স্থানীয় তৃণমূল নেতা অঘোর হেমব্রমের বক্তব্য, “আমরা দীর্ঘ সময় ধরে ধারাবাহিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। সেই তুলনায় সামান্য সন্ত্রাস করছে মাওবাদীরা। ওরা সন্ত্রাসের রাজনীতি আর উন্নয়নের বিরোধিতা করে বলেই আমরা প্রতিরোধ করেছি। মানুষ খুন করে ওরা আন্দোলন দমাতে পারবে না।” |