জোড়া খুনের প্রতিক্রিয়ায় দু’রকম ছবি বলরামপুরে
মাওবাদী হামলায় জোড়া খুন হয়েছে সোমবার। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়ায় মঙ্গলবার দু’টো আলাদা ছবি দেখাল পুরুলিয়ার বলরামপুর।
একটা অংশে আতঙ্ক ফিরেছে চেনা চেহারায়। অন্য অংশে চোখে পড়েছে আতঙ্ক কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার মরিয়া প্রয়াস। প্রথমটা অযোধ্যা পাহাড় লাগোয়া ঘাটবেড়া-কেরোয়া পঞ্চায়েত এলাকা। ব্যাস ১৪-১৫ কিলোমিটার। দ্বিতীয়টা ১৫ কিলোমিটার দূরের বলরামপুর সদর এবং তাকে কেন্দ্র করে ৭-৮ কিলোমিটার ব্যাসের একটা বৃত্ত।
ঘাটবেড়া-কেরোয়া এলাকারই খুনটাঁড় গ্রামে তৃণমূল কর্মী রাজেন সিংহ সর্দারকে বাড়িতে না পেয়ে তাঁর বাবা অজিত ও ভাই বাকুকে গুলি করে খুন করে মাওবাদীরা। মঙ্গলবার যৌথ বাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও সেখানে ফিরে এসেছে মাস পাঁচেক আগের নির্বাচন-পূর্ববর্তী আশঙ্কার বাতাবরণ। বিধানসভা ভোটের আগে পুলিশের চর সন্দেহে বলরামপুরের একাধিক খুন করেছে মাওবাদীরা। নিরাপত্তার কড়াকড়ি করেছিল যৌথ বাহিনীও। সে সময়ে এলাকার মানুষ তটস্থ থাকতেন। স্থানীয় সূত্রের খবর, অযোধ্যা পাহাড়ের কোল ঘেঁষা গ্রামগুলোতে ফের সেই আতঙ্কের আবহ ফিরিয়ে এনেছে সোমবারের জোড়া খুন।
আতঙ্ক কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রয়াস। বলরামপুর বাজারে মঙ্গলবার।
এ দিন সকালে সুনসান খুনটাঁড় গ্রামে চলছিল যৌথ বাহিনীর টহল। আতঙ্ক সেখানে কতটা, তা স্পষ্ট নিহত অজিতবাবুর স্ত্রী চারুবালা সিংহ সর্দারের কথায়। এ দিন দুপুরে পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার সুনীলকুমার চৌধুরীকে নিয়ে তাঁদের বাড়িতে যান আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) গঙ্গেশ্বর সিংহ। পুলিশ-কর্তাদের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়া চারুবালাদেবীর আর্জি, “আপনারা এখানেই থাকুন। আমার স্বামী ও ছেলেকে খুন করার সময় মাওবাদীরা বলে গিয়েছে, আবার এসে সবাইকে শেষ করে দেবে!”
বিধানসভা ভোটের সময়েও মাওবাদীদের হুমকি উপেক্ষা করে অযোধ্যা পাহাড় লাগোয়া এই সব গ্রামের বাসিন্দারা ভোট দিতে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, হয়তো স্বাভাবিক হবে পরিস্থিতি। শান্তি ফিরবে। কিন্তু এলাকায় তৃণমূলের প্রভাব বৃদ্ধি এবং মাওবাদীদের বিরোধিতা করে ‘জঙ্গলমহল উন্নয়ন বিরোধী প্রতিরোধ কমিটি’ গড়ে ওঠার পর থেকে পরিস্থিতি বদলায়। ঘাটবেড়া-কেরোয়া পঞ্চায়েতেরই ঘাটবেড়া গ্রামে গত ৩ নভেম্বর রাতে মাওবাদীরা খুন করে তৃণমূল কর্মী জিতু সিংহকে। তার পরে সোমবার রাতের হামলা। ফলে, আতঙ্ক এখনও নিত্যসঙ্গী এলাকাবাসীর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু গ্রামবাসীর কথায়, “বনপার্টিরা এখনও গ্রামে আসে। পুলিশ তো সারাক্ষণ আমাদের নিরাপত্তা দেবে না। ফলে, পরপর তিনটে খুনের পরে আমরা আরও ভয়ে আছি। বাড়ি থেকে বেরোনোর সাহসই পাচ্ছি না।” শুধু ঘাটবেড়া-কেরোয়া পঞ্চায়েত এলাকা নয়, এই আতঙ্কের শরিক বাইরে থেকে কাজে ওই এলাকায় যাওয়া জনতার একাংশও। প্রশাসন সূত্রের খবর, প্রতিদিন ঝাড়খণ্ডের চাণ্ডিল থেকে বলরামপুর সদরে আসে যে সব ট্রেকার, এ দিন তাদের সংখ্যা ছিল কম। পুরুলিয়া সদর থেকে বলরামপুরের ওই প্রত্যন্ত এলাকায় নিত্যযাত্রীদের প্রায় ৪০ শতাংশ এ দিন কাজে যাননি। যাঁরা গিয়েছেন, তাঁদের অনেকে বিকেল ৩টে বাজতেই রওনা দিয়েছেন স্টেশনের দিকে। কয়েকজন বললেন, “মাস পাঁচেক সব ঠিক ছিল। কিন্তু এখন পর পর খুন হচ্ছে। ভরসা পাচ্ছি না। অন্ধকার নামার আগেই এই এলাকা ছেড়ে বেরোতে পারলে বাঁচি।”
আতঙ্ক ফিরেছে চেনা চেহারায়। অযোধ্যা পাহাড় লাগোয়া ঘাটবেড়া গ্রামে সুনসান চারদিক।
তবে অন্য দিকও আছে বলরামপুরের। ব্লক সদরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা ছিল দোকানপাট। রাস্তায় যান চলাচলও স্বাভাবিক। মঙ্গলবারের সাপ্তাহিক হাটও ছিল জমজমাট। সেই হাটেরই সব্জি বিক্রেতা গঙ্গাধর মাহাতো, নারায়ণ মাহাতোরা, চম্পা মাহাতোরা বললেন, “আতঙ্ক আছেই। অনেক দিন ধরেই রক্ত ঝরা দেখছি। কিন্তু পেটের টানে বাড়ি থেকে বেরোতেই হবে। আমার গরিব মানুষ। ভয়ে কত দিন ঘরে বসে থাকব?”
বলরামপুরের বিডিও অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, এ দিন সকালেই তিনি ঘাটবেড়া-কেরোয়া পঞ্চায়েত অফিসে গিয়ে উন্নয়নমূলক বৈঠক করেছেন। তিনি বলেন, “পরপর কিছু ঘটনা ঘটেছে। তার একটা প্রভাব তো রয়েছেই। তা সত্ত্বেও সাপ্তাহিক হাট বসেছে। জনজীবন মোটের উপরে স্বাভাবিক ছিল। ওই পঞ্চায়েতের কর্মীদেরও বলেছি, মনোবল হারানো চলবে না। উন্নয়নের কাজ করতেই হবে।” জিতু সিংহের হত্যার প্রতিবাদে বলরামপুরে সভা করে গত ১১ নভেম্বর এই বার্তাই তো দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উন্নয়ন দিয়ে মাওবাদীদের জন-বিচ্ছিন্ন করার ডাক দিয়েছিলেন। সেই সূত্র ধরেই এ দিন বলরামপুর ব্লক তৃণমূল সভাপতি সৃষ্টিধর মাহাতো, জঙ্গলমহল উন্নয়ন বিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চের নেতা অঘোর হেমব্রম বললেন, “মাওবাদীরা সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে। কিন্তু মানুষ যে খুনের রাজনীতি পছন্দ করেন না, তা প্রমাণ হয়েছে এ দিন বলরামপুরের একাংশে জনজীবন স্বাভাবিক থাকায়।”

ছবি দু’টি সুজিত মাহাতোর তোলা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.