|
|
|
|
ইডেনে সৌরভের সারাদিন |
সচিনের ‘জন্মদিনে’ নির্লিপ্ত ইডেন, সৌজন্য সিএবি |
গৌতম ভট্টাচার্য • কলকাতা |
সচিন তেন্ডুলকরের মঙ্গলবার বাইশ বছরের ‘জন্মদিন’ গেল। এই জন্মদিন অবশ্য মুম্বই পুরসভার বার্থ সার্টিফিকেট মেনে নয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর রেজিস্টার্ড জন্মদিন। আর সচিন যখন বার্থডে বয়, তখন চমকপ্রদ রেকর্ডের ব্যাপারও অনিবার্য ভাবে থাকে। যেমন এখানে রয়েছে।
করাচিতে ১৫ নভেম্বর, ১৯৮৯ যে দিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মাঠে তাঁর অভিষেক, পুরো দিনটা কেটেছিল ফিল্ডিং করে। বাইশ বছর পূর্তির দিনটাতেও ঘটনাক্রমে ব্যাট হাতে উঠল না। জনতা সচিনকে দেখতে পেল মাত্র ১২ ওভার। তা-ও আউটফিল্ডে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাট করার সময়।
সচিনের সেই আন্তর্জাতিক অভ্যুদয়ের সময় বার্লিন প্রাচীর অক্ষত। মনমোহনী উদার অর্থনীতি কী লোকে জানে না। ৯/১১ ঘটেনি। অনিল কুম্বলে বলে কেউ দেশের হয়ে খেলেননি। বিশ্বে কমিউনিজমের স্বপ্ন আক্রান্ত হয়নি। ইন্টারনেট বলে কিছু আসতে পারে একমাত্র কল্পবিজ্ঞানই ভেবেছে।
সেই সময় থেকে আজ সভ্যতা, প্রযুক্তি এবং ক্রিকেটীয় যা সব বিবর্তন ঘটেছে তা পেরিয়ে আসা এক জন মানুষকে যুগন্ধর বললেও সামান্য কিছু অসম্পূর্ণ থাকে। অথচ প্রশ্ন, এত বড় কীর্তিকে সম্মানিত করার সুযোগ পেয়েও ইডেন তা হাতছাড়া করল কেন? না কি গোটা ফোকাসটাই ভ্রমাত্মক ভাবে ছিল ক্রিকেট সেঞ্চুরি নামক একটা মহাদুর্মূল্য বস্তুর ওপর?
সিএবি-র অভ্যন্তরে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সচিন একশো সেঞ্চুরি পূর্ণ করলে একশো গিনি দিয়ে তাঁকে বিশেষ সম্মান জানানো হবে। সেই অনুযায়ী স্বর্ণকারের দোকানে আগাম অর্ডার দেওয়াও হয়েছিল। সচিন প্রথম ইনিংসে ব্যর্থ হওয়ার আগেই এমন আলোচনাও হয় যে, সেঞ্চুরি যদি ইডেনে না হয়ে মুম্বই বা অন্য কোথাও হয়, তা হলেও বিশেষ কৃতিত্ব হিসেবে সিএবি তাঁকে গিনিগুলো উপহার দেবে কি না?
কয়েক জন প্রভাবশালী সদস্য বলেন, “সেটা ঠিক হবে না। কীর্তিটা ইডেনে হলে তবেই আমরা উপহার দেব।” মঙ্গলবার পর্যন্ত যা টেস্টের পরিস্থিতি, তাতে স্বর্ণকারের কাজ শেষ করে ফেলার কোনও দরকার আছে বলে মনে হচ্ছে না। সেঞ্চুরি না হলে যেখানকার গিনি সেখানেই রয়ে গেল। |
|
সচিন ‘বাইশ’। মঙ্গলবার ইডেনে। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস। |
স্থানীয় ক্রিকেটমহলে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে দু’রকম মত থাকলেও একটা বিষয় নিয়ে মতদ্বৈধ নেই। তা হল, সচিনের বাইশ বছর পূর্তির দিনটা নিজেদের মাঠে পেয়েও সিএবি তা অনুচ্চারিত রাখল কেন? আধুনিক ক্রিকেটে কোনও ক্রীড়াবিদ বাইশ বছরের গণ্ডিতে হাত ছোঁয়াতে পারেননি। এই উপমহাদেশে সবচেয়ে বেশি দিন খেলেছেন ইমরান খান। একুশ বছর। যাঁর ক্রিকেটজীবনের মেয়াদকে এ দিন সচিন অতিক্রম করে গেলেন। কিন্তু স্থায়িত্বে ইমরানের চেয়ে সচিন অনেক এগিয়ে। একুশ বছরে ইমরান খেলেছেন মাত্র ৮৮ টেস্ট। মাঝেমাঝেই স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছেন সিরিজ থেকে। সিনবোনে অপারেশনের জন্য একটা পিরিয়ডে তিন বছর বল করেননি।
স্থায়িত্ব এবং উৎকর্ষের মাপকাঠিতে তাই মঙ্গলবার বাইশ বছরে পা দেওয়া সচিনের ক্রিকেট জন্মদিন তাঁর পনেরো হাজার রান এবং ৯৯ সেঞ্চুরির পাশে রাখার মতোই মাইলফলক। আশ্চর্যজনক ভাবে, গোটা দিনে পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে এক বারের জন্যও কেউ তা বলেননি। মাঠের মধ্যে সচিনকে ডেকে সম্মানিত করা তো অনেক দূরের ব্যাপার। একটা ফুলের তোড়াও কেউ ভারতীয় ড্রেসিংরুমে পাঠানোর প্রয়োজন মনে করেনি। অথচ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ক্রিকেটে এর চেয়ে বেশি স্থায়িত্ব একমাত্র এক জনের আছে। এবং তিনিও সামগ্রিক বিচারে সচিনের চেয়ে পিছিয়ে।
তিনি ব্রায়ান ক্লোজ। টেস্টজীবন বহাল ছিল ১৯৪৯ থেকে ১৯৭৬। সাতাশ বছর। কিন্তু খেলেছেন মাত্র ২২ টেস্ট ম্যাচ। সচিনের মতো শরীর, মন এবং ফর্মের ওপর টানা বাইশ বছর ধরে চলে আসা একটা জাতির অপরিসীম দাবি মেটানোর ধারেকাছেও ক্লোজকে যেতে হয়নি। বরঞ্চ টানা উৎকর্ষের মাপে সচিনের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী গ্যারি সোবার্স। যদিও সোবার্স থেমে গেছেন কুড়ি বছরের গণ্ডিতে। ভারতীয় সুপারস্টারদের মধ্যেও সচিনের পাশে রাখার মতো কেউ নেই। কপিল দেব খেলেছেন সতেরো বছর। গাওস্কর ষোলো বছর। কুম্বলে আঠারো বছর। দ্রাবিড়ের চলছে সবে পনেরো বছর।
|
আধুনিক ক্রিকেটে দীর্ঘতম টেস্ট কেরিয়ার |
কে |
সময় |
সাল |
টেস্ট |
ওয়ান ডে |
সচিন তেন্ডুলকর |
২২ বছর |
১৯৮৯-২০১১ |
১৮৩ |
৪৫৩ |
ইমরান খান |
২০ বছর ২১৮ |
১৯৭১-১৯৯২ |
৮৮ |
১৭৫ |
ববি সিম্পসন |
২০ বছর ১৩১ দিন |
১৯৫৭-১৯৭৮ |
৬২ |
২ |
গ্যারি সোবার্স |
২০ বছর ৬ দিন |
১৯৫৪-১৯৭৪ |
৯৩ |
১ |
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ক্রিকেটে সচিনের সামনে শুধু ইংল্যান্ডের ব্রায়ান ক্লোজ। ২৬ বছর ৩৫৬ দিন। ১৯৪৯-’৭৬-এর মধ্যে তিনি অবশ্য খেলেছেন মাত্র ২২ টেস্ট। |
|
|
এমন অনন্য কীর্তিকে সিএবি কর্তারা উপেক্ষা করলেন? না কি বেমালুম ভুলেই গেলেন? এর আগে সচিনের কুড়ি বছরের ক্রিকেটজীবন পূর্ণ হওয়ায় যখন দেশে সংবর্ধনার ঢেউ উঠেছে, তখন সিএবি মহাকর্তা লিখিত বিবৃতি পাঠিয়েছিলেন যে, তাঁরা নাকি জমকালো সংবর্ধনা দেবেন সচিনকে। সেটা আজও হয়নি। সম্ভবত সচিন অবসর নেওয়ার পরে হবে।
সিএবি-র বতর্মান প্রশাসনের একাংশকে যাঁদের বেশ কিছু দিন জুরাসিক পার্ক-সদৃশ মনে হচ্ছে, তাঁরা অবশ্য আশ্চর্য নন। ইদানীংকালের হালচাল এ রকমই। সুঁটে বন্দ্যোপাধ্যায়ের শতবার্ষিকীর খবর কাগজে বেরোলে তবে প্রশাসনের টনক নড়ে। পঙ্কজ রায়ের ছবি গোটা ক্লাবহাউসে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাজ বেঙ্গলে বোর্ডের ওয়ার্কিং কমিটি বৈঠকের জন্য লাগানো ছবি হুবহু তুলে এনে ইডেনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছবি হিসেবে ক্লাবহাউসের গেটে বিশেষ চিত্র প্রদর্শনী হিসেবে লাগিয়ে দেওয়া হয়। সেই ছবির জমায়েতের মধ্যে বেশ কিছু ছবি যদি বেখাপ্পা এবং একেবারেই ইডেন-অসম্পর্কিত লাগে তাতে তাই আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
আম সমর্থক একশো সেঞ্চুরির মৌতাতে ভুলে বাইশতম জন্মদিন বিস্মৃত হতে পারে। স্থানীয় ক্রিকেট কর্তারা কী করে এত বড় ভুল করতে পারেন? না কি ওয়াকিবহাল মহলের যা মনে হচ্ছে সেটাই দস্তুর। সচিনের প্রতি অসৌজন্যই সামগ্রিক পরিস্থিতির স্বাভাবিক ছায়াপাত!
একমাত্র মুখরক্ষা হতে পারে যদি টেস্টের শেষ দিন পুরস্কার বিতরণীর সময় সচিনকে বিশেষ সম্মান জ্ঞাপন করা হয়। কিন্তু মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত কর্তারা সেই ‘প্ল্যান বি’-ও ভেবে উঠতে পারেননি। আসলে ‘প্ল্যান এ’-ই যেখানে নেই সেখানে ‘প্ল্যান বি’-র অস্তিত্ব থাকে কী করে! |
|
|
|
|
|