|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
যদি ‘সপ্তপদী’র পাশে রাখি ‘কোমল গান্ধার’ |
ঔপনিবেশিক পর্বে তো বটেই, উপনিবেশ-উত্তর কালেও ক’জন বাঙালি তরুণতরুণী শেক্সপিয়রকেই
ব্যবহার
করছে দু’টি ছবিতেই। চলতি কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে এরা বন্ধনীভুক্ত। ফিরে দেখলেন
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় |
পঞ্চাশ বছর আগে আমরা দু’টি বিবাহ প্রস্তুতি প্রত্যক্ষ করেছিলাম। ‘কোমল গান্ধার’ ছবিটি শেষ হয় অনসূয়া ও ভৃগুর করবন্ধনে; পৌরোহিত্য করেছিলেন ঋত্বিককুমার ঘটক। ‘সপ্তপদী’তে রিনা ব্রাউন ও কৃষ্ণেন্দুর বিরহ মধুর করার দায় নিয়েছিলেন অজয় কর। বাণিজ্যিক ভাবে চূড়ান্ত ব্যর্থ ‘কোমল গান্ধার’ চলচ্চিত্রের এক অসামান্য স্বর্গাভিযান। অন্য দিকে ‘সপ্তপদী’ বক্স-অফিসের সুগন্ধ। এ বারের চলচ্চিত্র উৎসব যে ছবিদুটিকে বন্ধনীভুক্ত করে স্মরণ করেছে, তাতে শিল্প আর বাণিজ্যের মধ্যে যে বিরোধ, চলতি বিচারবুদ্ধিতে, তার খানিকটা অবসান ঘটল। কিন্তু, রুচির তারতম্য লক্ষ্য করার বদলে আমি বরং সবিস্ময়ে খেয়াল করেছি যে আসলে সিনেমার দাম্পত্য কী ভাবে ইতিহাসের গোপন সংলাপ হয়ে ওঠে। ‘সপ্তপদী’ যে মিলনান্তক হবে তা বলা নিষ্প্রয়োজন, কিন্তু ‘আইজ হইব সীতার বিয়া’ গানটির সূত্রে ‘কোমল গান্ধার’-এর সমাপ্তিও মিলনে। এক ধরনের নৈতিকতার দায় এখানে বাফার শট-এর বিয়োগচিহ্নটিকে মুছে দিয়েছে। পিটার ব্রুকস হয়তো এ রকম মেলোড্রামার দিকে তাকিয়েই লিখেছেন, ‘দি এথিক্যাল ইমপারেটিভ রিপ্লেসেস দ্য ট্র্যাজিক ভিসন’।
|
|
ঋত্বিক ঘটকের ‘কোমল গান্ধার’ ছবিতে সুপ্রিয়া চৌধুরী এবং অবনীশ বন্দ্যোপাধ্যায়।
|
‘কোমল গান্ধার’, ‘সপ্তপদী’ |
শিয়ালদা স্টেশনে বাস্তুহারা বধূর ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে সুপ্রিয়া চৌধুরী ঘোমটা একটু টেনে দেন। আমরা বুঝি এই সীমন্তিনী আসলে ইতিহাসের কুললক্ষ্মী। যেমন ভাবে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’-র সত্যজিৎ রায়-কৃত প্রচ্ছদে, তেমন ভাবেই ‘কোমল গান্ধার’-এর নায়িকার মুখ আইকনপ্রতিম; সে আসলে বাঙালির জোন দ্য আর্ক বেহুলা।
রাত্রি এসে যখন মেশে দিনের পারাবারে, আমাদের বৈশাখ যখন মিলিয়ে যায় আশ্বিনে, আমাদের চরাচর, আমাদের দিগন্তরেখা, নৈশ সড়ক ও মেট্রো বিকিরণে অনসূয়া কেবলই প্রতীক্ষায় থাকে। জীবনে, মহত্ত্বে, তুচ্ছতা ও গ্লানিতে সে চিত্রার্পিত। জনরোষমুখরিত এই শহরে অথবা বীরভূমের রক্তবর্ণ মৃত্তিকায় তার অলজ্জ পদপাত, সুখে গৌরীর আঁখি ছলছল, তাঁর কাঁপিছে নিচোলাবরণ অনসূয়া তবে প্রচ্ছন্ন স্বদেশ। অনসূয়ার দ্বিধাকম্পিত ওষ্ঠাধর তবে কার প্রতীক্ষায় ছিল? অনসূয়া যদি কখনও প্রণয়প্রাথির্নী হয়ে থাকে, তা ইতিহাসের। যে নারী মেঘনাদের সহমরণে যায় মধুসূদনের কাব্যে, ছিন্ন খঞ্জনার মতো যে তরুণী ইন্দ্রের সভায় জীবনানন্দের সৌজন্যে, সে-ই ঋত্বিকের নায়িকা সময়ের আশ্চর্য সংলাপ। ছবির শেষে যে করবন্ধন, তা উঠে আসে সংস্কৃতির হৃদয়ের থেকে। ইতিহাস তাকে নানা রকম আবরণে ঢেকে রেখেছিল। সংস্কৃতমন্ত্রের সঙ্গে মিলে যায় প্রাকৃত উলুধ্বনি। আমাদের দেশবিভাগ, আমাদের স্বজন-বিরোধ, আমাদের ছিন্নগ্রন্থি দিনরাত্রি, আমাদের বিরহ এগিয়ে যায় পূর্ণতার দিকে।
কত দিন কত যুগ ধরে সীতা, আমাদের কৃষিকন্যাটি আকুল হয়ে ছিল এই কৌমার্য মোচনের জন্য। তৃতীয়ার চাঁদের মতো কাস্তের তলায় সুপ্রিয়ার মুখে অহল্যার শাপমুক্তির রেখাচিত্র: কত কাছে তবু কত দূর! ‘একটি বাস্তবধৃত বহুবিষয়সমন্বিত একটি জটিল নকশা প্রস্তুত করাই ছিল অভিপ্রেত’, ঋত্বিক বলেন।
তাঁর অনসূয়া তো আসলে কালিদাসের শকুন্তলা ও শেক্সপিয়রের মিরান্দার উপনিবেশ-উত্তর দৃষ্টিপাত। |
|
অজয় করের ‘সপ্তপদী’ ছবিতে উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেন।
|
কেন পাশাপাশি |
অজয় কর জনপ্রিয় সিনেমার এমন একজন কথক যিনি অবলীলায় ঐতিহ্য ও আধুনিকতার একটি সেতু তৈরি করতে পারেন। সাঁকোটি নড়বড়ে কি না তা স্বতন্ত্র প্রশ্ন, কিন্তু কালিদাসের উপাখ্যানে হারানো আংটির পুনরুদ্ধার যেমন দুষ্মন্ত ও শকুন্তলাকে মিলিত করে, ‘হারানো সুর’ ছবিতেও (১৯৫৭) সেই বিচ্ছেদ ও মিলনের গল্পটিকে নতুন করে বলা হয়। হলিউড থেকে শেখা ব্যাকলাইট ব্যবহার তিনি উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেনের চুলের ফাঁকে ফাঁকে এমন ভাবে ছড়িয়ে দেন যে তার নাটকীয়তা হলিউড মেলোড্রামার বদলে হিন্দু পৌরাণিকতার অনেক কাছাকাছি চলে যায়। ‘সপ্তপদী’র কৃষ্ণেন্দু মিশনারি হয়ে যেতে পারে, কিন্তু তার মুখাবয়বে স্পষ্ট ধরা পড়ে একজন মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রণয় আদল। আবার ভেবে দেখলে ‘ওথেলো’ অভিনয়ের পর্বটুকুতে শেক্সপিয়রকে সাক্ষী রেখেই এক বাঙালি তরুণ তার প্রণয়িনীর কাছে স্পর্শের আঁচ পেতে চায়, টু ডাই আপন আ কিস। আর সেই কামনা কী অসামান্য ভাবে প্রেমে দাউদাউ করে ওঠে, তা এই দৃশ্যপর্যায়ে এক্সপ্রেশনিস্ট আলো ও মিড লংশটগুলিকে দেখলে বোঝা যায়। অথবা মত্ত মাধবীলতার মতো রিনা ব্রাউন যখন ট্রেনের ধাতব শব্দে কাঁপতে থাকা আয়নায় কৃষ্ণেন্দুকে দেখে ভ্রষ্ট স্মৃতি উদ্ধার করে, সেই মুহূর্তটি।
আসলে এই মুহূর্তটিই মেলোড্রামার অভিজ্ঞান-অঙ্গুরীয়। অবস্থানচ্যুতি ও বিপুল শহরায়নের ফলে নতুন বুর্জোয়া সমাজের নাগরিকের যে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা, তার পাল্টা অবস্থান থেকেই আজ ‘কোমল গান্ধার’ ও ‘সপ্তপদী’কে পড়া উচিত। পঞ্চাশ দশকের শেষে একটি স্বাধীন গণতন্ত্র সব সময় তার নাগরিককে নিরাপত্তা দিতে পারেনি। অন্তত মানসিক ভাবে ফেলে আসা সভ্যতার স্মৃতি এই আপাত সামাজিক বিশৃঙ্খলাকে ব্যক্তির সুষম মিলন কেন্দ্রে পৌঁছে দিতে চেয়েছে। রিনা ব্রাউন বা ভৃগুর যদি কোনও মনোবিকার থেকে থাকে তা নতুন মূল্যমানের সঙ্গে বসবাস করার অস্বস্তি থেকে জাত।
‘গ্রাম শহরের গল্প’ নামে গত শতকের চল্লিশ দশকের এক কাহিনিতে জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘সে পাড়াগাঁর জীবন তুমি কোনদিন ফিরে পাবে না অন্তত তেমন করে কিছুতেই না; না, শচী, কিছুতেই না, আমিও তাই গাঁয়ের পথে আর ফিরে যাই না, ভাবতেও চাই না, পাড়াগাঁ কেমন।’
দেশবিভাগের সীমানা বিন্যস্ত হল, কিন্তু আমাদের মন এলোমেলো হয়ে গেল। মার্ক্সস যাকে বলেন, জাতপাতভিত্তিক গ্রামীণ সমাজব্যবস্থা, তাও ভেঙে পড়ল। এই ঘূর্ণিবাত্যার মুহূর্তটিই আধুনিক মেলোড্রামার মুহূর্ত। এই পর্যায়ে পরিবারের বিন্দুতে ইতিহাসের সিন্ধু-দর্শন অনেক সময়ই ইতিহাসের নিয়তি। স্বাধীন দেশে নানা সামাজিক দুর্যোগ বিশেষত আমাদের ভূস্বামী ও পুঁজিপতিদের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ গ্রাম থেকে শহরে আসার পথটিকে মসৃণ হতে দেয়নি। আর দেশভাগজনিত মনোবিপর্যয় তো ছিলই। ঔপনিবেশিক পর্বে তো বটেই, এমনকী আধুনিকতায় পা দেওয়ার মুহূর্তে উপনিবেশ-উত্তর কালে কয়েকজন বাঙালি তরুণ-তরুণী শেক্সপিয়রকেই ব্যবহার করছে দু’টি ছবিতেই। বোঝা যায় আমাদের অনেক সংস্কারের সঙ্গে ‘পশ্চিম’-ও একটি সংস্কার যেখানে শেক্সপিয়র একটি মুদ্রা।
ঋত্বিক হয়তো রবীন্দ্রনাথের শকুন্তলা প্রবন্ধটির পুনর্পাঠে নতুন ঠিকানা পেতে চেয়েছেন, কিন্তু যারা রিনা ব্রাউন! একদা গোরার জন্মরহস্য আমাদের ভাবিয়েছিল। এই সমাজ এই নতুন নাগরিককে কী ভাবে ছাড়পত্র দেবে, তা হয়তো ষাট দশকের সূচনায় আমাদের জানা ছিল না। পর্দা পার হয়ে এই চরিত্ররা আজ ইতিহাসের চৌরাস্তায়। অনসূয়া ও রিনা ব্রাউন আজ আমাদের মুক্তবুদ্ধি বান্ধবী। পঞ্চাশ বছর আগে মনে হয়েছিল এরা আখ্যানের পাত্রপাত্রী। চিনতে পারিনি তো!
|
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্রবিদ্যার শিক্ষক |
|
|
|
|
|