|
|
|
|
প্রবন্ধ ৩... |
জনতার উৎসব? |
সুবিধাভোগীদের কবল থেকে বেরোতে পারল চলচ্চিত্র উৎসব? প্রশ্ন তুলেছেন
সোমেশ্বর ভৌমিক |
চলচ্চিত্র উৎসবে ভাল ছবি দেখার জন্যে সিনেমা-বিশেষজ্ঞ হতেই হবে বা সিনেমার তত্ত্ব জানতেই হবে, এমন ঠুলি-পরা কৌলীন্য নাকি গা থেকে ঝেড়ে ফেলেছে এ বারের আয়োজন। (‘বিশেষজ্ঞ না হলে..., ’ ৯/১১) কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের প্রথম আয়োজন থেকেই দর্শক হিসেবে অংশগ্রহণ করার সুবাদে জোর দিয়েই বলতে পারি এ রকম কল্পিত কৌলীন্যের গরিমা বা বিজ্ঞাপন কখনওই দেখিনি। হ্যাঁ, এমন অনেকেই এই উৎসবে এসেছেন সিনেমার তত্ত্ববিৎ হিসেবেই যাঁদের সুখ্যাতি। কিন্তু শুধু তাঁরা এসেছেন বলেই এই উৎসব বিশেষজ্ঞদের উৎসব? কোনও সমাজেই এ রকম মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়। কলকাতাতেও নয়। ফলে, উৎসবে শামিল হওয়ার আগ্রহ বেশি ছিল তাঁদেরই, যাঁদের পরিচয় নিছক চলচ্চিত্র-রসিক। একটু ধৈর্য ধরে পরিসংখ্যান নিলেই দেখা যেত, এঁরাই কলকাতা উৎসবে ছিলেন ব্রাত্য। কারণ সূচনালগ্ন থেকেই রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের কারণে আর বিভিন্ন সরকারি বিভাগের দাক্ষিণ্য-বিতরণের প্রতিযোগিতায় বঞ্চিত হয়ে এসেছেন বেশ কিছু সত্যিকার চলচ্চিত্রপ্রেমী।
এই বঞ্চনা থেকে রেহাই মিলল কি তাঁদের? একমাত্র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানই যা ব্যতিক্রম। নন্দনের জায়গায়
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। দশ টাকার টিকিট কেটে জনসাধারণের প্রবেশাধিকার। হাজার দশেক মানুষের ছবি দেখার সুযোগ। সংবাদমাধ্যমের চোখে এটা বিরাট পরিবর্তন। কিন্তু সেই জনতার মধ্যে ক’জন পরবর্তী সাত দিন ধরে নন্দন-সহ কয়েকটি বাছাই করা প্রেক্ষাগৃহে ছবি দেখার সুযোগ পাবেন? টিকিট কেটে ছবি দেখার ব্যবস্থা নিউ এম্পায়ার, স্টার, ফেম, সাউথ সিটি আর নবীনায়। হিসেব নিলে দেখা যাবে, সব ক’টি প্রেক্ষাগৃহের দর্শকের সিংহভাগই হলেন আসলে বিশেষ সুবিধাভোগীর দল। |
|
শোনা যাচ্ছে, এই উৎসব ফিল্ম সোসাইটির ফসল, এমন ধারণারও নাকি অবসান হতে চলেছে। খুবই প্রতীকী মনে হচ্ছে, এই বছরেই বিদায় নিয়েছেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত, কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। উনিশশো পঞ্চাশ, ষাট আর সত্তরের দশকে ফিল্ম সোসাইটিগুলো ছিল সাংস্কৃতিক পরিসরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সিনেমার বাণিজ্যিক পরিকাঠামোটি এক সংকীর্ণ পরিসরের মাধ্যমটিকে বেঁধে রাখতে চায়। ফিল্ম সোসাইটিগুলো বোঝাতে পেরেছিল শিল্প হিসেবে সিনেমার সম্ভাবনা আরও ব্যাপক। সেই সম্ভাবনার নিদর্শনগুলি তারা খুঁজে আনত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবকে হয়তো তত্ত্বগত ভাবে ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের সম্প্রসারণ হিসেবেই ভাবা হয়েছিল। কিন্তু যে হেতু আয়োজনটি সরকারি, কার্যক্ষেত্রে ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়াল অন্য। অবশ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের গুরুত্ব আর জোরও কমে এসেছিল। এ-ও মনে করতে পারি, এক ধরনের উচ্চম্মন্যতা গ্রাস করেছিল উদ্যোক্তাদের। তা হলেও চলচ্চিত্র-সচেতনতা প্রসারের লক্ষ্যে ফিল্ম সোসাইটি কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্যটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি, এখনও।
একটা সময় ছিল যখন এই সব উৎসবকে তুড়ি মেরে বাণিজ্যে ব্যস্ত থেকেছেন মূলধারার ছবির কর্ণধারেরা। সে দিন আর নেই। তাঁদের ব্যবসার ক্ষেত্র বাড়ছে, বাড়ছে অনিশ্চয়তাও। এখন তাঁরা বুঝছেন, উৎসবে ছবি ঢোকাতে পারলে ভাল বিজ্ঞাপন হয়, মানও বাড়ে। শুধু এখানে নয়, সারা পৃথিবী জুড়েই এখন তাই চলচ্চিত্র উৎসবের উপর মূলধারার ছবির চাপ। তাঁদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশই থাকত না, যদি চলচ্চিত্র প্রদর্শনের বাজারটাকে স্রেফ কব্জা করে না-রেখে অন্য মেজাজের ছবি দেখানোর জন্য খুলে দিতেন তাঁরা।
আমাদের চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীদের কি অনুরোধ করা যায় না, তাঁদের হলগুলোয় অন্তত নভেম্বরের এই এক সপ্তাহ অন্য মেজাজের ছবি দেখানোর ব্যবস্থা হোক? তা হলে ফেস্টিভ্যালে প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য হাহাকার কমবে, ছবির সংখ্যা বাড়ানো যাবে। সবচেয়ে বড় কথা ‘মুষ্টিমেয়’র ফেস্টিভ্যাল সত্যি অর্থে জনতার উৎসব হয়ে উঠবে। প্রস্তাবটা অলীক? |
|
|
|
|
|