প্রবন্ধ ১...
যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি
লেখনী পুস্তিকা ভার্যা
পরহস্তং গতা গতাঃ!
প্রথমে ভার্যার কথাই বলা যাক। আমার স্ত্রী যদি এক্ষণে অপর কোনও পুরুষের হাত ধরে, আমাকে টা টা বাই বাই বলে ড্যাং ড্যাং করে চলে যায়, তা হলে আমার তো বাধা দেওয়ার কোনও উপায় নেই। এটা নারীস্বাধীনতার যুগ। আমি নিজেও তো কট্টর নারীবাদী। এমতাবস্থায় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আমাকে হাসি হাসি মুখে বলতে হবে, সুখে থেকো, ভাল থেকো!
এ রকম উদারতা দেখাতে গেলেও অনেক সময় উল্টো বিপত্তি হতে পারে। ওপরের এই চিত্রনাট্যটা যদি আমার স্ত্রীকে শোনাই, তা হলে তিনি নির্ঘাত চক্ষু গাঢ় করে বলবেন, ও, তুমি বুঝি চাও, আমি অন্য কারওর সঙ্গে চলে যাই? তা হলে তুমি বাঁচো! আমাকে তোমার আর সহ্য হচ্ছে না, না? সে কথা আগে বললেই পারতে? ঠিক আছে, আমি কালই...
অগত্যা তাঁর মনোরঞ্জনের জন্য আমাকে কালিম্পঙের টিকিট কাটতে হয়।
মোট কথা, নারীবাদী আন্দোলনের অগ্রগতির একটা দিক হচ্ছে, এক শ্রেণির পুরুষকে এখন বেশ ভয়ে ভয়েই থাকতে হয়। যাতে কোনও কথার একটুও ভুল ব্যাখ্যা না করা যায়।
উপরোক্ত অর্বাচীন সংস্কৃত শ্লোকটির মধ্যে এখন লেখনীর ব্যাপারটা অবান্তর হয়ে গেছে। কলম নিয়ে কে আর মাথা ঘামায়! এখন কলম হয়ে গেছে অত্যন্ত সস্তা। হস্তান্তর হচ্ছে অনবরতই। পার্কার, শেফার্স এবং আরও সব দামি কলমের দিন গিয়েছে।
ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর বাবা আমাকে একটা শেফার্স কলম উপহার দিয়েছিলেন। দিন সাতেকের মধ্যেই ট্রামে সেই কলমটা এক পকেটমার অদৃশ্য করে দেয়। ঘটনাটা আমার মনে আছে। আমার কলমটি মেরে দিয়েও খুশি না-হয়ে পকেটমারটি আবার হাত চালাচালি শুরু করে এবং ধরা পড়ে যায়। তখন তাকে ট্রাম থেকে নামিয়ে কিছু লোক, যাদের বলে পাবলিক, তারা পেটাতে শুরু করে। চোরাই কোনও জিনিস অবশ্য তার কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। তা কোন জাদুবলে সে তার কোনও সঙ্গীর কাছে চালান করে দিয়েছে। তার মার খাওয়া দেখে আমার কষ্ট হচ্ছিল খুব এবং সেই পাবলিকের কাছে ব্যর্থ অনুরোধ করেছিলাম, ছেড়ে দিন, ছেড়ে দিন। পকেটমারটি অবশ্য দিব্যি মার খেয়ে যাচ্ছিল। পরে শুনেছি, ওরা মার খাওয়ার ট্রেনিং নেয়। নিশ্বাস বন্ধ করে কী সব যোগব্যায়ামের সাহায্যে ব্যথা-বেদনা সহ্য করে। তাই মার খেতে খেতে আধমরা হয়ে গেলেও একটু পরে দৌড়ে পালিয়ে যায়। তখনকার পাবলিক চড়চাপড় মেরে বড়জোর আধমরা করে দিত। একেবারে প্রাণে মারত না।
তার পর থেকে আমি আর কখনও দামি কলম ব্যবহার করিনি। এক টাকা, দু’টাকার ডটপেনই যথেষ্ট। পকেটমার বেচারাদের নিশ্চয়ই এখন খুব দুর্দিন। কারওর পকেটেই দামি কলম থাকে না, মানিব্যাগে টাকার বদলে প্লাস্টিক কার্ড, মেয়েদের গায়ে সোনার গয়নার বদলে প্লাস্টিক জুয়েলারি।
এই চুরি বা না-বলে নেওয়া কিংবা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও না-দেওয়া, এ সব বিষয়ে অনেক গল্প আছে। মার্ক টোয়েনের বাড়ির মেঝেতে একগাদা বই ছড়ানো দেখে এক বন্ধু বিস্ময় প্রকাশ করলে মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, কী করব, যে ভাবে এই বইগুলি এখানে এসেছে, সে ভাবে তো কোনও আলমারি আসতে পারে না।

কালি, কলম মন...। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সম্প্রতি বই চুরির ব্যাপারে আমার এমনই এক অভিনব অভিজ্ঞতা হল। যা সবাইকে জানাবার মতো।
গত সপ্তাহে আমি আফ্রিকার ঘানায় গিয়েছিলাম একটা বইমেলা উপলক্ষে। এক দুপুরে হোটেলের ঘরের তালা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখি, আমার বিছানার কাছে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। পুরোপুরি কৃষ্ণাঙ্গ। অল্পবয়সি যুবক। প্রথমে কোনও আততায়ীর কথাই মনে পড়ে এবং ভয়ে বুক তো কাঁপবেই।
ছেলেটি অবশ্য খুব বিনীত ভাবে বলল, (এখানে সবাই ইংরেজি বলে) স্যার, আমি আপনার ঘর পরিষ্কার করি। দু’দিন ধরে দেখছি, আপনার বিছানার উপর একটা বই ওল্টানো রয়েছে। আমি একটু একটু পড়তে শুরু করি। বিষয়টি এমনই আকর্ষণীয় যে, ছাড়তেই পারছিলাম না। কিন্তু আপনাকে জিজ্ঞেস না-করে তো নিতে পারি না। আপনি এই বইটা আমাকে দেবেন?
আমি বললাম, বইটা তোমাকে কী করে দিই বলো তো? আমার যে পড়া হয়নি।
সে বলল, বইটা কোথায় পাওয়া যায়? আপনি কোথা থেকে কিনেছেন?
আমি বললাম, কোথায় পাওয়া যায়, তা তো আমি জানি না। কারণ, বইটি আমি কিনিনি। এ বইয়ের লেখক আমাকে উপহার দিয়েছেন।
সে বলল, কেন উপহার দিয়েছেন? তুমিও লেখক?
আমি বললাম, তা ছোটখাটো এক জন লেখক আমাকে বলাই যায়।
সে বলল, এক জন লেখক তোমাকে বই উপহার দিয়েছেন। তা হলে তোমার লেখা একটা বই আমাকে উপহার দাও।
আমি বললাম, তা দিতে পারি। কিন্তু তুমিও কি লেখক?
সে বলল, না। আমি এখনও কিছু লিখিনি। তবে ভবিষ্যতে লিখতেও পারি।
এমন সরল আবেদন আমি কোনও গৃহ পরিচারকের কাছ থেকে আগে শুনিনি।
এ বার বইটি সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বলি। বইটির নাম ‘আমা’। এক কালে এখানে যে দাস ব্যবসা চলত, উপন্যাসের আকারে সেই ইতিহাস। এক হিসেবে এই উপন্যাসেও আছে নারীস্বাধীনতার বীজ, প্রধান চরিত্র একটি নারী। অসহ্য অত্যাচার, ধর্ষণ, হাত-পায়ে শিকল বাঁধা অবস্থাতেও সে স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে, পালাবার চেষ্টা করেছে বার বার। বইটি পড়তে পড়তে একটা প্রশ্ন মনে আসে, যারা এই দাস ব্যবসায় জড়িত (শুধু শ্বেতাঙ্গ নয়, এদের মধ্যে কালো মানুষও আছে) তারা নিজের জাতের বাইরে অন্য মানুষদের মানুষ বলেই গণ্য করে না। যখন তখন চাবুক মারে। মেয়েদের প্রকাশ্যে বিবস্ত্র ও ধর্ষণ করতে পারে। আজ এরা তো স্ত্রী-পুত্র নিয়ে দিব্যি সংসার করে। যে সব ঘটনার কথা পড়ে আমরা শিউরে উঠি, তাতে এদের বিবেকে একটুও দাগ কাটবে না? তা হলে কি সভ্যতা ও সংস্কৃতির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বিবেক ও মূল্যবোধেরও পরিবর্তন ঘটেছে, দয়া, মায়া, সহানুভূতি সব এ কালের ব্যাপার? একটু পরেই আমার মনে পড়ে, না, তা তো নয়। প্রায় ছাব্বিশশো বছর আগে জন্মেছিলেন গৌতম বুদ্ধ। তিনি করুণার প্রতিমূর্তি এবং তিনি একা নন, তাঁর শান্তি-নীতির অনুবর্তী হয়েছিলেন কোটি কোটি মানুষ। দু’হাজার বছর আগে যিশু খ্রিস্টও শুনিয়েছিলেন শান্তির বাণী। আবার তাঁর অনুগামীদের অনেকে লিপ্ত হয়েছিলেন দাস ব্যবসায়। ইতিহাসে দুটো ধারাই চলেছে পাশাপাশি। নিষ্ঠুরতা ও করুণা। চেঙ্গিস খান এক লক্ষ বন্দির মুণ্ডু কাটার হুকুম দিয়েছিলেন। হিটলার একটা জাতিকেই না নিশ্চিহ্ন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পৃথিবীতে এখন দাস ব্যবসা নিষিদ্ধ। কিন্তু এখনও কি বহু মানুষকে দাস বানাবার প্রক্রিয়া চলছে না?
দু’দিন বাদে আমি ছেলেটিকে ডেকে বললাম, বইটা আমার পড়া হয়ে গেছে। তুমি এখন নিতে পারো।
সে বলল, ধন্যবাদ স্যর। আমি এর মধ্যেই এক কপি কিনে নিয়েছি।

শ্রীজয়ন্ত চক্রবর্তীকে আমি চিনি না। পরিচিতিতে জানলাম, তিনি একজন ইঞ্জিনিয়ার। ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক জন ফেলো। ডি ভি সি-তে কর্মরত অবস্থায় তিনি বাংলায় এম এ পাশ করেন। সংস্কৃত শিখেছেন। হিন্দিতেও কিছু গবেষণা করেছেন এবং তাঁর এক সময় শখ হয় ব্রাহ্মী লিপি পাঠ করার। সেই শখ থেকেই গভীর চর্চা করে ব্রাহ্মী লিপি থেকে আরও নানা লিপির বিবর্তনে কী ভাবে বাংলা লিপির উদ্ভব হল, সেই বিষয়ে তিনি একটি চটি বইও লিখে ফেলেছেন।, ‘ব্রাহ্মী থেকে বাংলা’। এর বিষয়বস্তু হৃদয়ঙ্গম কিংবা যাচাই করার মতো বিদ্যেবুদ্ধি আমার নেই। তবে শ্রীঅমলেন্দু দে-র মতো প্রখ্যাত পণ্ডিত এঁর কাজের প্রশংসা করেছেন।
বইটি খুবই দীন ভাবে ছাপা। ভেতরে যে সব হস্তলিপি, তা প্রায় পড়াই যায় না। কোনও বড় প্রকাশক এ রকম বই সম্পর্কে আগ্রহী নয়। এটা প্রকাশ করছে সঞ্চয়ন প্রকাশন। ১২১/এ সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট, কলকাতা-৯। বিজ্ঞান ও ভাষা সংস্কৃতিকে যাঁরা মেলাতে পারেন, তাঁরা আমাদের অবশ্যই শ্রদ্ধেয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.