|
|
|
|
রাজনীতির চাপে তিন বছর পরে দাম কমলো পেট্রোলের |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি ও কলকাতা |
জনমোহিনী রাজনীতির কাছে হার মানল অর্থনীতি। চাপের মুখে প্রায় তিন বছর পরে পেট্রোলের দাম কিছুটা কমলো। আজ দাম কমানোর এই সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছে তেল সংস্থাগুলি। মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকেই নতুন দাম কার্যকর হবে।
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পেট্রোলের দাম আরও এক দফা বাড়ার পরেই কড়া ভাষায় হুমকি দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান শরিক, তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই চাপের সঙ্গে যোগ হয় বিজেপি-সহ বিরোধীদের হইচইতে আসন্ন শীতকালীন অধিবেশন অচল হওয়ার আশঙ্কা। সর্বোপরি মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায় নাভিশ্বাস উঠতে থাকা আমজনতার ক্ষোভ। এই তিন চাপের মুখে মাথা নুইয়ে পেট্রোলের দাম কমানো হল। অর্থনীতির হিসেব শিকেয় তুলে দিয়ে। কেন্দ্রীয় সরকারের চাপেই রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থাগুলি এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হল বলে মনে করা হচ্ছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থাগুলি পেট্রোলের দাম লিটারে ১ টাকা ৮৫ পয়সা কমিয়েছে। যার সঙ্গে করের পরিমাণ যোগ করলে কলকাতায় পেট্রোলের দাম কমছে প্রতি লিটারে ২ টাকা ৩১ পয়সা। মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে পেট্রোলের দাম কমে হচ্ছে লিটার প্রতি ৭০ টাকা ৮৪ পয়সা। তেল সংস্থাগুলির এই সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই স্বস্তির শ্বাস ফেলেছেন। গত বছর জুনে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়ার পর পেট্রোলের দাম দফায় দফায় বেড়েছে। শুধু এ বছরেই পাঁচ বার দাম বেড়েছে পেট্রোলের। দাম কমার ঘটনা গত তিন বছরে এই প্রথম। শেষ বার দাম কমেছিল ২০০৯-এর জানুয়ারিতে। পেট্রোলের দাম আনুষ্ঠানিক ভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা হলেও বাস্তবে যে সরকার তেল সংস্থাগুলির উপরে চাপ তৈরি করতে পারে, আজ তার প্রমাণ মিলেছে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম বৃদ্ধি ও ডলারের তুলনায় টাকার দাম কমে যাওয়ার যে যুক্তিতে নভেম্বরের শুরুতে পেট্রোলের দাম বাড়ানো হয়েছিল, সেই সব যুক্তি এখনও বর্তমান। যাঁর নেতৃত্বাধীন কমিটির সুপারিশে পেট্রোলের দাম সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা হয়েছিল, তেল কোম্পানিগুলির আজকের সিদ্ধান্ত শুনে সেই কিরীট পারিখের কটাক্ষ, “ভারতের মতো দেশে সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়ার ধরন যেমন হতে পারে, তেমনই হয়েছে!” |
|
নভেম্বরের ৩ তারিখে পেট্রোলের দাম ১ টাকা ৮২ পয়সা বাড়ানোর পরেই কেন্দ্রীয় সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য শরিকরাও দাম বাড়ানোর বিষয়ে কমবেশি আপত্তি তোলে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী, দু’জনেই জানিয়ে দেন, রাজনৈতিক চাপের সামনে তাঁরা পিছু হঠবেন না। তৃণমূলের সাংসদরা দিল্লিতে এসে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আপত্তি জানিয়ে গিয়েছিলেন। মমতাও কলকাতায় প্রণববাবুর সঙ্গে বৈঠক করেন। শেষ পর্যন্ত তৃণমূল সমর্থন প্রত্যাহার না করায় অভিযোগ উঠেছিল, রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা মেনে চরম অবস্থান থেকে পিছু হঠলেন মমতা। আজ পেট্রোলের দাম কমানোর সিদ্ধান্তের পর তৃণমূল-শিবির মনে করছে, আমজনতার চাপের সামনে কেন্দ্রীয় সরকার তথা কংগ্রেস নেতৃত্বই পিছু হঠতে বাধ্য হলেন।
মহাকরণে মমতা বলেন, “আমরা আগে থেকেই বলেছি, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলে সব জায়গাতেই দাম কমা উচিত। পেট্রোলের দাম কমেছে, তাই ওঁদের ধন্যবাদ।” একই সঙ্গে গ্যাস, কেরোসিন এবং ডিজেলের দামও যাতে আর না বাড়ে, সে জন্য কেন্দ্রের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। পেট্রোলের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের ফলে সব স্তরে ক্ষোভের আঁচ টের পেয়ে কংগ্রেসের তরফেও বলা হচ্ছিল, সাধারণ মানুষকে সুরাহা দিতে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। স্বয়ং সনিয়া গাঁধীও দাম কমানোর পক্ষে সওয়াল করেন। স্বাভাবিক ভাবেই আজকের সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট কংগ্রেস। দলের মুখপাত্র জনার্দন দ্বিবেদী বলেন, “এর ফলে আমজনতার সুরাহা হবে।”
শুধু শরিকরা নয়, আগামী সপ্তাহ থেকে সংসদের অধিবেশন শুরু হলে বিজেপিও যে এ বিষয়ে কড়া অবস্থান নেবে, ইউপিএ-সরকার তা ভাল ভাবেই বুঝতে পারছিল। গত কাল রাতে সুষমা স্বরাজ ও অরুণ জেটলির সঙ্গে বৈঠক করেন প্রণববাবু। আর্থিক সংস্কারের কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেনশন তহবিল নিয়ন্ত্রণ বিলের মতো একগুচ্ছ বিল এই অধিবেশনে পাশ করাতে চাইছে কেন্দ্র। কিন্তু বিজেপি নেতারা জানিয়ে দেন, তাঁরা কোনও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিতে পারছেন না। বিরোধী আসনে থাকলে কোনও দলই তেলের দাম নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ ছাড়ে না। কংগ্রেসও বিরোধী আসনে থাকার সময় তেলের দাম বৃদ্ধির বিরোধিতা করেছে। বিজেপিও সেই সুযোগ ছাড়বে না ইঙ্গিত দেওয়ার পরেই ফের পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের তরফে তেল সংস্থাগুলির কাছে বার্তা পাঠানো হয়। আর্থিক ক্ষেত্রে সংস্কারের কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে জ্বালানি ক্ষেত্রে সংস্কারের কর্মসূচিকে আপাতত পিছনের সারিতে সরিয়ে রাখারই সিদ্ধান্ত হয়।
সংসদের অধিবেশন শুরুর মাত্র ক’দিন আগে তেলের দাম কমানোর এই সিদ্ধান্তে যথেষ্ট অস্বস্তিতে বিরোধী বিজেপি ও বামেরা। সরকারের উপর চাপ বাড়াতে বিজেপির দাবি, মাত্র দু’টাকা দমা কমানো যথেষ্ট নয়। লিটারপিছু পাঁচ টাকা কমাতে হবে! অন্য দিকে দাম কমানোর পিছনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাপ’কে কটাক্ষ করে বামেদের বক্তব্য, তৃণমূল নেত্রী এ বার তা হলে তেলের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনার দাবি তুলুন!
পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের তরফে অবশ্য যুক্তি দেওয়া হয়েছে, আজকের তেলের দাম কমানোর সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। পেট্রোলিয়াম প্রতিমন্ত্রী আর পি এন সিংহ বলেন, “আগে যে পেট্রোলের দাম বাড়ানো হয়েছিল, তা থেকে সরে আসা হল না। গত ১৫ দিনের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেই তেল সংস্থাগুলি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের তরফে কোনও চাপ তৈরি করা হয়নি। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলে আবার পেট্রোলের দাম কমানো হবে।” ইন্ডিয়ান অয়েলের চেয়ারম্যান আর এস বুটোলা জানিয়েছেন, গত ১৫ দিনে আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৫ ডলার কমেছে। ডলারের তুলনায় টাকার মূল্যেরও কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু বাস্তব হল, ভারতে সবথেকে বেশি যে অশোধিত তেল আমদানি করা হয়, সেই ব্রেন্ট ক্রুডের দাম কমেছে খুবই সামান্য। অন্য দিকে ডলারের তুলনায় টাকার দাম গত দু’দিনে ফের পড়েছে। আজ এক ডলারের মূল্য দাঁড়িয়েছে ৫০ টাকা ৬৭ পয়সা। গত ৩২ মাসে টাকার দাম কখনও এত নীচে নামেনি। তা সত্ত্বেও তেলের দাম কমানো হল কেন? যেখানে আজই ‘আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে’ বিমানের জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে!
ইন্ডিয়ান অয়েল, ভারত পেট্রোলিয়ামের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির যুক্তি, গত দু’দিনে যে ফের টাকার মূল্য কমেছে, তা হিসেবের মধ্যে রয়েছে। তা যদি আরও কমে, তা হলে ১৫ দিন পরে যখন পর্যালোচনা করা হবে, সেখানে তার প্রভাব দেখা যাবে। কিন্তু আজকের পর্যালোচনায় দেখা গিয়েছে, অশোধিত তেলের দাম ও ডলারের তুলনায় টাকার মূল্যের হিসেবে তেল সংস্থাগুলির লিটার প্রতি ১ টাকা ৮৫ পয়সা লাভ বা ‘ওভার-রিকভারি’ হচ্ছে। সাধারণ মানুষ যাতে এর পুরো সুবিধা পান, তাই ঠিক সেই পরিমাণেই তেলের দাম কমেছে। এর ফলে পেট্রোল বিক্রি করে তাদের লাভ বা ক্ষতি কিছুই হচ্ছে না বলে তেল সংস্থাগুলির দাবি। এর সঙ্গে রাজ্যভিত্তিক করের হিসেব যোগ হয়ে বিভিন্ন রাজ্যে তেলের দাম ২ টাকা ২২ পয়সা থেকে ২ টাকা ৩৫ পয়সার মধ্যে কমবে। রাজ্যগুলি যুক্তমূল্য করের হার কমালে সাধারণ মানুষ আরও কম দাম পেট্রোল কিনতে পারেন।
অর্থনীতিবিদদের প্রশ্ন, পেট্রোলের দাম যখন আনুষ্ঠানিক ভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত, তখন তা লাভজনক হারে বিক্রি করা হবে না কেন? বিশেষত ডিজেল, কেরোসিন ও রান্নার গ্যাস সরকারের ঠিক করে দেওয়া দামে বেচতে গিয়ে এখন তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার দৈনিক ৩৬৭
কোটি টাকা করে ক্ষতি হচ্ছে! গত তিন মাসে তিনটি তেল সংস্থাই প্রচুর পরিমাণে ক্ষতি হয়েছে। সেই ক্ষতির বোঝা মাথায় নিয়েও যেভাবে পেট্রোলের দাম কমানো হল, তাতে রাজনীতির কাছে অর্থনীতি ফের হার মানল বলেই সংশ্লিষ্ট মহলের মত। |
|
|
|
|
|