প্রথাগত চাষে ঝুঁকি কম নেই। কখনও অতিফলন, কখনও সংরক্ষণ ও বিপণনের
অভাব ডেকে আনে সর্বনাশ। তবু ধান, পাট, আলু চাষ আঁকড়ে আছেন অনেকেই।
বিকল্প চাষ কি দেখাতে পারছে মুক্তির পথ? আজ দ্বিতীয় কিস্তি। |
ধান, আলু বা পাট চাষে লাভে অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও ফলন বাড়ছে মহকুমায়। এমনটাই দাবি কৃষি দফতরের। লোকসানের সমূহ সম্ভাবনা থাকলেও কেন চাষিরা প্রথাগত চাষকে আঁকড়ে রয়েছেন, তা বোঝা যায় তাঁদের কথাতেই।
কালনা মহকুমার সব থেকে বড় ব্লক মন্তেশ্বর। এখানে রয়েছে মোট ১৩টি পঞ্চায়েত। এই সব এলাকার চাষিদের স্লোগানই হল, ধান থেকে ধান। অর্থাৎ, এক বার ধান চাষের পরে ফের সেই জমিতে ধান চাষেরই প্রস্তুতি শুরু করা। বছরের পর বছর ধরে এমন প্রথাতেই অভ্যস্ত কয়েক হাজার চাষি। ধান চাষি রবিন ঘোষের কথায়, “বংশ পরম্পরায় আমরা তো এ ভাবেই চাষ করে আসছি। কী দরকার অন্য চাষ করতে গিয়ে ঝুঁকি নেওয়ার?” নিজেদের এলাকায় প্রথাগত চাষের বাইরে অন্য কী ধরনের লাভজনক চাষ হতে পারে, সে ব্যাপারে তাঁদের কোনও স্বচ্ছ ধারণাই নেই বলে জানান চাষিরা।
অথচ প্রথাগত চাষের অনিশ্চয়তা থেকে বেরিয়ে আসতে কৃষি দফতরের দাওয়াই ‘বিকল্প চাষ’। কিন্তু এ ব্যাপারে যে চাষিদের বিশেষ কিছু জানা নেই, তা তাঁদের সঙ্গে কথা বললেই জানা যায়। অল্প কয়েকটি জায়গায় কিছু বিকল্প ফসলের চাষ হলেও অধিকাংশ এলাকাতেই চাষিদের এ ব্যাপারে বিশেষ ধারণা নেই। অনেকে আবার নতুন কোনও চাষের ঝুঁকি নিতেও নারাজ।
পূর্বস্থলী-২ ব্লকে বিকল্প চাষ হিসেবে গত দু’বছর ধরে নানা সব্জি ও ফলফুলের চাষ হচ্ছে। রবি মরসুমে পূর্বস্থলীর কালেখাঁতলা ১ বাজার-সহ বেশ কিছু এলাকা থেকে ট্রাক ভর্তি সব্জি শুধু এ রাজ্যেই নয়, পাড়ি দেয় ভিন রাজ্যেও। তবু এই চাষ নিয়ে বিস্তর ক্ষোভ রয়েছে। চাষিদের দাবি, বিকল্প হিসেবে সব্জি চাষে উৎসাহ বাড়াতে তৈরি হয়নি কোনও হিমঘর। ফলে ফসলের অভাবি বিক্রি চাষিদের কাছে সাধারণ ঘটনা। মাঠ থেকে ফসল আড়তে নিয়ে যাওয়ার বেশির ভাগ রাস্তাই বেহাল। পরিকাঠামোর অভাবে ধুঁকছে ছোট-বড় আড়তগুলিও।
চাষিরা জানাচ্ছেন, স্বস্তি নেই ফুলের চারা চাষেও। চারা বিক্রির জন্য কোনও বাজার নেই এলাকায়। ভিন রাজ্যের ব্যবসায়ীরা ভিড় জমালে ভাল বিক্রি হয় চাষিদের। তাই অনিশ্চয়তা রয়েছে এই চাষেও। মূলত এ জন্যই দু’দশকেও পূর্বস্থলী এবং পলাশপুর গ্রাম ছাড়া মহকুমার অন্যত্র এই ফুলের চারা চাষ খুব বেশি জনপ্রিয় হয়নি। পূর্বস্থলী-১ ব্লকের শ্রীরামপুর এলাকায় এক দশক আগে স্থানীয় চাষিদের মধ্যে অনেকেই ধান-পাট ছেড়ে পেয়ারা চাষ শুরু করেন। কিন্তু চাষিদের ক্ষোভ, এলাকায় পেয়ারার কোনও বাজার নেই, পেয়ারাকে কেন্দ্র করে কোনও শিল্পও গড়ে ওঠেনি। কালনা ১ ও ২ ব্লকে বিকল্প চাষ হিসেবে কোনও এলাকায় শীতকালীন সব্জি এবং সর্ষে চাষ হলেও তা নিতান্তই অল্প।
বছর ছয়েক আগে কৃষি দফতরের উদ্যোগে মহকুমায় সূর্যমুখীর চাষ শুরু হয়েছিল। কিন্তু ভাল ফলন না হওয়ায় ঝুঁকির রাস্তায় আর হাঁটেনি ওই দফতর। এক আধিকারিকের কথায়, “এক বার কোনও চাষে বিফল হলে চাষিদের বোঝানো কঠিন হয়ে পড়ে। তাই আর সূর্যমুখীর কথা ভাবা হয়নি।” মহকুমা কৃষি দফতরের এক বিশেষজ্ঞ নিলয় করের বক্তব্য, “বিকল্প চাষের ব্যাপারে সাধ্য মতো উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা হল, কোনও এলাকার চাষিরা এক বার একটি প্রথাগত চাষে অভ্যস্ত হয়ে গেলে আর ঝুঁকির রাস্তায় হাঁটতে চান না।”
নিলয়বাবু উৎসাহ দেওয়ার কথা বললেও চাষিরা কৃষি দফতরের উদ্যোগের কথা মানতে নারাজ। মহকুমার চাষিদের অভিযোগ, আগে মাঝে-মধ্যে চাষাবাদের ব্যাপারে আলোচনাসভা আয়োজন করা হলেও এখন মহকুমায় সে সব প্রায় হয়ই না। এ দিকে, বিকল্প চাষ জনপ্রিয় না হওয়ার কারণ হিসেবে ফসলের বিপণন ব্যবস্থা দুর্বলতাও দায়া বলে জানান এক কৃষি আধিকারিক। সব মিলিয়ে, লোকসানের আশঙ্কা সত্ত্বেও সেই প্রথাগত চাষ আঁকড়েই থাকতে হচ্ছে চাষিদের।
|