|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
কবিতা ও ছবির পারস্পরিক কথোপকথন |
সিমা-য় চলছে পরেশ মাইতির ‘শেষ লেখা’ শীর্ষক একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ |
রবীন্দ্রনাথের শেষতম কাব্যগ্রন্থ ‘শেষ লেখা’। এটি প্রকাশিত হয় কবির প্রয়াণের অব্যবহিত পরে ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে। ১৫টি কবিতা রয়েছে এই সংকলনে। সেগুলি ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৯এর মধ্যে লেখা। শেষ কবিতাটি ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে’ মুখে মুখে রচনা করেছিলেন ৩০ জুলাই, ১৯৪১ তারিখে অস্ত্রোপচারের কিছুক্ষণ আগে। এই কালপর্বে রবীন্দ্রনাথ অজস্র কবিতা লিখেছিলেন। সেগুলি সংকলিত হয়েছে ‘রোগশয্যায়’, ‘আরোগ্য’, ‘জন্মদিনে’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থে। এর অনেক কবিতাই কবির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে স্বীকৃত।
প্রখ্যাত লেখক, কবি ও সম্পাদক প্রীতীশ নন্দী ‘শেষ লেখা’র কবিতাগুলি ইংরাজিতে অনুবাদ করেছিলেন ১৯৭৩ সালে। সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশতবর্ষে সেই ১৫টি কবিতার উপর ছবি এঁকেছেন সুপরিচিত শিল্পী পরেশ মাইতি। প্রীতিশের অসামান্য সুন্দর ক্যালিগ্রাফিতে হাতে লেখা সেই অনূদিত কবিতা ও প্রতিটি কবিতার উপর পরেশের জলরঙে আঁকা ছবি নিয়ে এখন প্রদর্শনী চলছে সিমা গ্যালারিতে। কবিতার ছবি ছাড়াও পরেশের রয়েছে আরও কিছু জলরঙের নিসর্গ চিত্র।
|
|
শিল্পী: পরেশ মাইতি
|
‘শেষ লেখা’র কবিতা নিয়ে ছবি করা খুব কঠিন। রবীন্দ্রনাথের অজস্র কবিতা আছে যা চিত্রময়। কিন্তু ‘শেষ লেখা’র অধিকাংশ কবিতাই গভীর দার্শনিক প্রজ্ঞায় তন্ময়। তাতে বর্ণনাত্মক ছবি খুবই কম। এছাড়া কবিতার চিত্রায়ণের আর একটি চিরন্তন সমস্যাও আছে। সাহিত্যে বা কবিতায় সময়ের যে সঞ্চরণ থাকে ছবিতে তা থাকে না। ছবি একটি মুহূর্তে স্থির হয়ে থাকে। নির্দিষ্ট পরিসরে আবদ্ধ সেই স্তব্ধতাকে নান্দনিক ভাবে জঙ্গম করে তুলতে পারাতেই এক জন শিল্পীর সাফল্য। পরেশ তাঁর নিজস্ব ঘরানার নিসর্গ এঁকেছেন। জলরঙের সেই দীপ্ত মাধুর্যের তুলনা বিরল। সেই ছবি তিনি এঁকেছেন কবিতা থেকে স্বনির্বাচিত একটি বাকপ্রতিমাকে অবলম্বন করে। তাতে সম্পূর্ণ কবিতাটির উপলব্ধি আশা করা যায় না। কিন্তু ওই একটি বাকপ্রতিমা কত নিবিড়তায় ব্যঞ্জিত হয়ে ভিন্নতর চৈতন্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে পারে, সেটা বোঝা যায়। আমরা পেয়েছি উদাত্ত অন্তর্লীন কিছু রচনা, যার অধিকাংশই নিসর্গধর্মী।
প্রথম কবিতাটি ‘সম্মুখে শান্তি পারাবার/ ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।...’ অনুবাদ করেছেন প্রীতীশ। এই কবিতার শেষ শব্দবন্ধ ‘মহা-অজানার’।
ইংরেজিতে ‘দ্য গ্রেট আননোন’। পরেশের ছবির শিরোনাম ‘দ্য গ্রেট আননোন’ এই ‘মহা-অজানার’ ছবি হতে পারে কী করে? এটাই সমস্যার। পরেশ এঁকেছেন নদী বা সমুদ্রতীরের নীলিম আঁধারের উদাত্ত ও দীপ্ত নিসর্গ। তারাখচিত রাত্রির অসীম শূন্যতার ভিতর সেই ‘মহা-অজানাকে’ উপলব্ধি করতে চেয়েছেন। নদীর প্রতিমাকল্প হয়তো এসেছে ‘ভাসাও তরণী’-র বাকপ্রতিমা থেকে। এই নিসর্গচিত্র স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। কিন্তু কবিতার সঙ্গে একাত্ম হতে পারে না কখনও।
তৃতীয় কবিতা অবলম্বনে করা ছবিটি, যার শিরোনাম ‘ফার্স্ট টাচ অফ ডন’, একটি অসামান্য নিসর্গচিত্র। এখানে নদী, ঊষার ধ্যানলগ্ন আকাশে সূর্যোদয়ের লালিমায় রঞ্জিত মেঘমালা, আর আছে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির উড়ে যাওয়া। ‘ওরে পাখি,/ থেকে থেকে ভুলিস কেন সুর’। কবিতা শুরুর এই বাক্যবন্ধে কোনও ছবি নেই। শিল্পী ছবির জন্য বেছে নিয়েছেন ‘অরুণ-আলোর প্রথম পরশ’ - এই বাকপ্রতিমাটি। নদীর উপর সেই ‘অরুণ-আলো’কে এঁকেছেন। অভিব্যক্তিবাদী নিসর্গের অনুপম রূপায়ণ এই ছবি।
চতুর্থ কবিতার অনুষঙ্গে শিল্পী এঁকেছেন ‘দ্য লোনলি আফটারনুন’ বা ‘জনহীন বেলা দু’পহরের’ ছবি। এঁকেছেন সেই চেয়ারটি যেটি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো কবিকে উপহার দিয়েছিলেন। তাতে পরিস্ফুট হয়েছে এই করুণা -‘শূন্য চৌকির পানে চাহি,/ সেখানে সান্ত্বনালেশ নাহি।’ ‘রূপনারায়ণের কূলে/ জেগে উঠিলাম, জানিলাম এ জগৎ/ স্বপ্ন নয়।’ একাদশ সংখ্যক কবিতার এই বাণীকেও ছবিতে ধরা যায় না। যেমন ধরা যায় না ‘সত্য যে কঠিন’ এই শব্দবন্ধকে। তাই শিল্পী এঁকেছেন নদীতীরে প্রভাতের ছবি যার নাম - ‘ব্যাঙ্ক অফ দ্য রূপনারায়ণ’।
‘প্রথম দিনের সূর্য/ প্রশ্ন করেছিল’ - এই কবিতায় চিত্ররিক্ততা অনেকটা প্রগাঢ়। ‘মেলে না উত্তর’এরও কোনও ছবি হয় না। তবু শিল্পী সেই ছবিটিই এঁকেছেন সৌন্দর্যের অমেয় বিস্ময়কে উদ্ভাসিত করে। শেষ কবিতা ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি’। এখানে ‘চিরস্বচ্ছে’ ‘অন্তরের পথ’ হয়ে উঠেছে শিল্পীর ছবির বিষয়। গহন এই নিসর্গটি স্বমহিমায় উজ্জ্বল। কিন্তু ‘অন্তরের পথ’কে কী ভাবে ধরা যাবে ছবিতে, এই সমস্যাটি থেকেই যায়। এই সীমাবদ্ধতাতেই কবিতা ও ছবির পারস্পরিক কথোপকথন। |
|
|
|
|
|