‘বিবেক দংশনে’ ধরা দিলেন মাওবাদী দম্পতি
মাওবাদীদের হিংসার পথ ছাড়ার জন্য লাগাতার হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলরামপুরে দলীয় কর্মী খুনের পরে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু করারও স্পষ্ট ইঙ্গিত দেন তিনি। এর দু’দিনের মধ্যেই পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন বলরামপুরেরই এক মাওবাদী-দম্পতি। যাদের এক জন বড়সড় বেশ কয়েকটি নাশকতার সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে পুলিশের দাবি। সেই অর্থে মাওবাদীদের সমাজের মূল স্রোতে ফেরানোর লক্ষ্যে পাঁচ মাসের মাথায় এটা একটা বড় সাফল্য। তবে এখনই আপ্লুত হতে রাজি নন রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা। তাঁরা আশা করছেন, কিছু দিনের মধ্যে এমন আত্মসমর্পণ আরও ঘটবে।
রবিবার দুপুরে পুরুলিয়ার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে যে দু’জন আত্মসমর্পণ করেছেন, সেই দুর্যোধন রাজোয়াড়ের বাড়ি পিলাই গ্রামে। তাঁর স্ত্রী আকরি সহিসের বাড়ি পাশের গ্রাম ঘাটবেড়ায়। বৃহস্পতিবার রাতে ওই ঘাটবেড়া গ্রামেই জিতু সিংহ নামে এক তৃণমূল কর্মীকে খুন করার অভিযোগ ওঠে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে। এর পরেই মাওবাদীদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর হওয়ার কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী। যদিও দুর্যোধন ও আকরির দাবি, গত বছর ডিসেম্বরে বাগবিন্ধ্যা-গণহত্যার পরে ‘বিবেক দংশন’ থেকেই তাঁদের আত্মসমর্পণের ভাবনা।
পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার সুনীলকুমার চৌধুরী বলেন, “এঁরা দু’জনেই মাওবাদীদের অযোধ্যা পাহাড় স্কোয়াডের সদস্য। স্কোয়াডে দুর্যোধনের নাম ছিল সুজন। ললিতা নামে পরিচিত ছিলেন আকরি। কিছু দিন ধরেই এঁদের সঙ্গে স্কোয়াডের যোগাযোগ ছিল না। এর পরে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওঁরা আত্মসমর্পণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।” পুলিশ সুপার আরও বলেন, “ওই দু’জন আমাদের জানিয়েছেন, স্কোয়াড থেকে বেরিয়ে গেলে পুলিশ ‘ভুয়ো সংঘর্ষ’-এ তাঁদের মেরে দেবে বলে সদস্যদের মধ্যে প্রচার করা হয়। সেই ভয় কাটিয়েই ওঁরা বেরিয়ে এসেছেন।” একই সঙ্গে তাঁর আশ্বাস, আত্মসমর্পণের প্যাকেজের জন্য এই দম্পতির নাম তাঁরা সরকারের কাছে সুপারিশ করবেন।
আত্মসমর্পণের পর পুরুলিয়ার পুলিশ সুপারের ঘরে মাওবাদী দম্পতি দুর্যোধন এবং আকরি। ছবি: সুজিত মাহাতো
পুলিশ জানিয়েছে, দুর্যোধন ২০০৫ সালে মাওবাদীদের সঙ্গে যোগ দেন। আকরি স্কোয়াডে আসেন গত বছরই। এ বছর জানুয়ারিতে তাঁদের বিয়ে হয়। এ দিন দুপুর ২টো নাগাদ কড়া পুলিশি পাহারায় গাড়িতে করে এসপি অফিসে আনা হয় দুর্যোধন ও আকরিকে। তাঁদের আপাতত সংশোধন-শিবিরে রাখা হবে। বস্তুত, এই প্রথম পুরুলিয়ায় কোনও মাওবাদী আত্মসমর্পণ করলেন। এর আগে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পশ্চিম মেদিনীপুরে তিন জন ও বাঁকুড়ায় পাঁচ জন মাওবাদী আত্মসমর্পণ করেছেন।
পার্থ-সৌম্যজিৎ অপহরণ-কাণ্ড, ঝালদার বাগবিন্ধ্যা গ্রামে সাত ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা-কর্মীকে খুন, আড়শার কাঁটাডি রক্ষীশিবির থেকে অস্ত্র লুঠ, বরাভূম স্টেশনে আরপিএফ জওয়ানদের খুন করে অস্ত্র লুঠ, বলরামপুরের বিরামডি স্টেশনে অগ্নিসংযোগ, বরাবাজারের বেড়াদায় স্ট্র্যাকো জওয়ানকে খুন করে অস্ত্র লুঠ-সহ বহু নাশকতায় দুর্যোধন প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত বলে পুলিশ সুপারের দাবি। এক পুলিশ-কর্তা বলেন, “গত কয়েক বছরে অযোধ্যা পাহাড় সংলগ্ন আড়সা, বাঘমুণ্ডি ও বলরামপুরে মাওবাদীদের হাতে যে ক’টি খুনের ঘটনা ঘটেছে, তার অধিকাংশতেই জড়িত এই দুর্যোধন।” এসপি-র দাবি, আকরিও বাগবিন্ধ্যা-কাণ্ডে জড়িত।
স্বাভাবিক ভাবেই যে জেলার ৮টি ব্লকই মাওবাদী প্রভাবিত হিসাবে চিহ্নিত, সেখানে দুর্যোধনের মাপের মাওবাদী সদস্য ধরা পড়া বিশেষ ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করছে জেলা পুলিশ ও জেলা তৃণমূলের একাংশ। ঘটনাচক্রে জিতু-হত্যাকাণ্ডের পরেই শনিবার একদা মাওবাদীদের ‘মুক্তাঞ্চল’ ঘাটবেড়ায় তৃণমূলের জনসভা থেকে মাওবাদীদের সমাজের মূলস্রোতে ফেরার আহ্বান জানানো হয়। ‘জঙ্গলমহল উন্নয়ন বিরোধী প্রতিরোধ কমিটি’র সভাপতি তথা তৃণমূল নেতা অঘোর হেমব্রম এবং তৃণমূলের বলরামপুর ব্লক সভাপতি সৃষ্টিধর মাহাতো মাওবাদীদের ‘হুঁশিয়ারি’ও দেন। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও সম্প্রতি মাওবাদীদের উদ্দেশে কঠোর বার্তা দিচ্ছিলেন। ১১ নভেম্বর বলরামপুরেই যাওয়ার কথা তাঁর।
এই আত্মসমর্পণ সাম্প্রতিক ‘পরিস্থিতির’ পরিণাম কি না, ভেঙে বলেননি ওই দম্পতি। কিন্তু এ দিন পুলিশ সুপারের অফিস চত্বরে আনন্দবাজারকে দু’জনেই জানিয়েছেন তাঁদের মাও-ঘনিষ্ঠতার ইতিবৃত্ত। দুর্যোধন বললেন, “তখন ফরওয়ার্ড ব্লক করতাম। জমি সংক্রান্ত ঝামেলায় জড়িয়ে আমাকে গ্রামছাড়া করে সিপিএম। সেই সময় মাওবাদীরা গ্রামে এসে ওদের সঙ্গে যোগ দিতে বলে। প্রথমে দলমা স্কোয়াডে ছিলাম। পরে অযোধ্যা স্কোয়াডে যাই।”
চা খেতে খেতে দুর্যোধন জানালেন, সিপিআই (মাওবাদী)-র রাজ্য কমিটির সদস্য এবং সামগ্রিক ভাবে অযোধ্যা স্কোয়াডের দায়িত্বে থাকা বিক্রমের সঙ্গে নিয়মিত দেখা হত তাঁর। বিক্রমকে তিনি ‘দাদা’ বা ‘ভানু দাদা’ বলে ডাকতেন।
পুলিশের দাবি, স্কোয়াডে দুর্যোধনকে ‘মাইন মাস্টার’ বলা হত। দুর্যোধন বলেন, “আমাকে ল্যান্ডমাইন তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।” কোথায় প্রশিক্ষণ জানতে চাওয়ায়, ছোট্ট জবাব ‘জঙ্গলে’। গত বছর ২৫ ডিসেম্বর ঝালদার ডাকাইপাহাড়ে দুর্যোধনেরই পোঁতা মাইন-বিস্ফোরণে এক কোবরা জওয়ানের মৃত্যু হয় এবং সাত জন জওয়ান আহত হন বলেও পুলিশের দাবি। ‘সাফল্যের’ সঙ্গে পরের পর নাশকতা ঘটানোয় স্কোয়াডে দুর্যোধনের ‘পদোন্নতি’ হয়। তিনি ‘সেকশন কমান্ডার’ হন। হাতে পান স্বয়ংক্রিয় রাইফেল বা এসএলআর। তবে ওই অস্ত্র তিনি সমর্পণ করেননি। পুলিশ সুপারের ব্যাখ্যা, “দুর্যোধন স্কোয়াড থেকে বাড়িতে যাবেন বলে ছুটি নিয়েছিলেন। এসএলআর স্কোয়াডের কাছেই জমা রেখে আসতে হয়েছে।”
বছর কুড়ির আকরি জানালেন, অভাবের সংসার ছেড়ে এক দিন সাড়া দিয়েছিলেন মাওবাদীদের ডাকে। তাঁর কথায়, “পরে স্কোয়াড সদস্য হই। বন্দুক চালানো শিখছিলাম।” মূলত স্কোয়াড-সদস্যদের রান্নার দায়িত্ব ছিল আকরির উপরে। তাঁর দাবি, বাগবিন্ধ্যার ঘটনাই তাঁর প্রথম ‘অ্যাকশন-অভিজ্ঞতা’। তবে সেখানে তিনি গুলি চালাননি। এর কিছু দিন পরেই বিয়ে এবং সমাজের মূলস্রোতে ফিরে আসার ভাবনা শুরু।
আকরির দাবি, “বাগবিন্ধ্যার এতগুলো লাশ দেখে গোটা ব্যাপারটার উপরেই আমার কেমন যেন ঘেন্না ধরে গিয়েছিল। রান্না করা আর স্কোয়াড সদস্যদের নানা ধরনের ‘আব্দার’ মেটানো আর ভাল লাগছিল না।” পাশ থেকে দুর্যোধন বললেন, “যে স্বপ্ন-আদর্শ নিয়ে স্কোয়াডে এসেছিলাম, তা পূরণ হল কই? শুধুই খুনোখুনি, মাইন পোঁতা। এই জীবনে বিতৃষ্ণা ধরছিল। আকরিও আমাকে বুঝিয়েছে। শেষে দু’জনে মিলেই আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিই।” কিন্তু কবে ও কী ভাবে স্কোয়াড থেকে বেরিয়ে এলেন, সে বিষয়ে তাঁরা কিছু জানাতে চাননি। শুধু বলেছেন, “পরিবারের সঙ্গে থাকতে চাই। বাড়িতে চাষবাস করব।”
মুখ্যমন্ত্রীর আত্মসমর্পণের প্যাকেজ কি শুনেছেন? দুর্যোধন-আকরির জবাব, “মুখ্যমন্ত্রী যে আমাদের মূলস্রোতে ফিরে আসতে বারবার বলেছেন, সেটা জানি।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.