কলকাতায় বায়ুদূষণের মাত্রা যত বাড়ছে, গাড়ির ধোঁয়া পরীক্ষার ক্ষেত্রে গাফিলতি ততই বাড়ছে। কারণ, গাড়ির ধোঁয়া পরীক্ষার (পলিউশন আন্ডার কন্ট্রোল সার্টিফিকেট) ব্যবস্থাটাই কার্যত ভেঙে পড়েছে। ধোঁয়া পরীক্ষার ভুয়ো সার্টিফিকেটের অভিযোগ বাড়ছে পাল্লা দিয়ে।
গত চার মাসেরও বেশি সময় ধরে গাড়ির ধোঁয়া পরীক্ষাকেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে জাল সার্টিফিকেট-চক্র নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া বন্ধ রেখেছে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ অটো এমিশন টেস্টিং সেন্টার’-এর করা একটি মামলা চলাকালীন হাইকোর্টের নির্দেশে পর্ষদকে কিছু দিন অভিযান বন্ধ রাখতে হয়েছিল। তার পরে আর অভিযান চালু করা হয়নি। পর্ষদের চেয়ারম্যান বিনয়কান্তি দত্ত অবশ্য এই অভিযোগ মানতে নারাজ। বিনয়বাবু বলেন, “অভিযান বন্ধ হয়েছে, বলা ঠিক নয়। পুজোর সময়ে বন্ধ ছিল। আবার আমরা সেই অভিযান শুরু করব।”
অথচ, কলকাতায় ৭০ শতাংশেরও বেশি গাড়ি ধোঁয়া পরীক্ষার ছাড়পত্র ছাড়াই রাস্তায় চলছে। যানদূষণ-বিশেষজ্ঞ সোমেন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, “কলকাতা এবং শহরতলি মিলে ৭৫ থেকে ৮০টা ধোঁয়া পরীক্ষাকেন্দ্র। অথচ, কলকাতা শহরে নথিভুক্ত গাড়ির সংখ্যা সাড়ে ১০ লক্ষেরও বেশি। হাওড়া, হুগলি, দুই ২৪ পরগনা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকেও প্রতিদিন অন্তত তিন লক্ষ গাড়ি শহরে ঢোকে।” তাঁর মতে, গাড়ির তুলনায় পরীক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা এতই কম যে, কেন শহরের বেশির ভাগ গাড়ির ধোঁয়া পরীক্ষার ছাড়পত্র নেই, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তা ছাড়া, কলকাতায় ছ’মাসে এক বার গাড়ির ধোঁয়া পরীক্ষা করালেই চলে। সেখানে মুম্বই বা দিল্লিতে তিন মাস অন্তর গাড়ির ধোঁয়া পরীক্ষা করাতে হয়। এটাও কলকাতায় বায়ুদূষণ বাড়ার কারণ। |
এর উপরে আছে জাল সার্টিফিকেট চক্র এবং ধোঁয়া পরীক্ষাকেন্দ্রের বিকল যন্ত্রপাতি। কেন্দ্রগুলির কাজে কোনও গাফিলতি বা অসঙ্গতি পেলে হাইকোর্টের নির্দেশে পর্ষদ ‘দূষণ জরিমানা’ হিসেবে ২৫ হাজার টাকা আদায় করতে পারে। পরিবহণ দফতর দোষী কেন্দ্রের সার্টিফিকেট বাতিল করতে পারে। কয়েকটি কেন্দ্রের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নেওয়ার পরেই ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ অটো এমিশন টেস্টিং সেন্টার’ ওই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে গিয়েছিল। আদালত আগের নির্দেশ বহাল রাখে। তার পরেও এক মাসের বেশি হয়ে গিয়েছে, কিন্তু পর্ষদ এখনও ধোঁয়া পরীক্ষাকেন্দ্রের অসঙ্গতি বা গাফিলতি ধরার অভিযান শুরু করেনি।
ধোঁয়া পরীক্ষার ভুয়ো সার্টিফিকেট-চক্র ভাঙতে রাজ্য সরকার ‘কম্পিউটারাইজড’ সার্টিফিকেট ব্যবস্থা চালু করে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চাপে এবং কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে গাড়ির ধোঁয়া পরীক্ষাও বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়। তার পরে গাড়ির ধোঁয়া পরীক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়তে থাকে শহরে। ধোঁয়া পরীক্ষার সার্টিফিকেট দেওয়ার নতুন পদ্ধতিতে ভুয়ো সার্টিফিকেট দেওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু অল্প কিছু দিনেই তাতেও জাল ছাড়পত্রের ফিকির খুঁজে নিয়েছে চক্র।
নতুন পদ্ধতিতে গাড়ি ধোঁয়া পরীক্ষার যন্ত্রের সামনে দাঁড়ালে ওয়েব ক্যামেরায় সেটির নম্বর প্লেটের ছবি উঠে যায়। একই সঙ্গে চলে ধোঁয়া পরীক্ষা। সরকারি হলোগ্রাম দেওয়া যে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়, তাতে নম্বর প্লেটের ছবি এবং ধোঁয়ায় দূষণের পরিমাণ, দুই-ই থাকে। সার্টিফিকেট দিতে যাতে পুরো প্রক্রিয়া মানা হয়, সে ভাবেই তৈরি হয়েছিল সফ্টওয়্যার। কিন্তু, সেই সফ্টওয়্যারেই বিকৃতি ঘটিয়ে এখন ইচ্ছেমতো ভুয়ো সার্টিফিকেট দেওয়া চলছে। সোমেন্দ্রনাথবাবু বলেন, “এখন পয়সা দিলেই গাড়ির নম্বর প্লেটের ছবির সঙ্গে আগের কোনও নতুন গাড়ির ধোঁয়া পরীক্ষার ফলাফল মিশিয়ে সার্টিফিকেট দিয়ে দেয় ওই সমস্ত চক্র। বহু জায়গায় নম্বর প্লেটের ছবি নিয়ে গেলেই ওই সার্টিফিকেট পাওয়া যায়।”
তবে, পরিবহণ বিভাগের সহকারী অধিকর্তা (কারিগরি) আশিসকুমার সিংহ বলেন, “আমাদের ভ্রাম্যমাণ দূরনিয়ন্ত্রিত ধোঁয়া পরীক্ষার যন্ত্র কলকাতা, হাওড়া, দুই ২৪ পরগনায় নিয়মিত চলমান গাড়ির ধোঁয়া পরীক্ষা করে এবং দূষণকারী গাড়ির মালিকদের জরিমানা করে। এখন আমাদের একটা গাড়ি, আরও চারটে আসবে।” |