পাকিস্তান যেতে পারেন মনমোহন
আবার শান্তি বৈঠক, উঠবে কাশ্মীর প্রসঙ্গ
দীর্ঘদিন পরে আরও এক বার পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। সেই লক্ষ্যে আসন্ন সার্ক সম্মেলনের ফাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির সঙ্গে বৈঠক হবে তাঁর। বৈঠকে কাশ্মীর নিয়ে কথা বলতেও মনমোহনের আপত্তি নেই। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রেও বলা হয়েছে, কাশ্মীরে স্বায়ত্তশাসনের প্রকৃতি কেমন হবে, তা নিয়ে একটি বিচারবিভাগীয় কমিশন গঠনের প্রস্তাব উঠবে মনমোহন-গিলানির আলোচনায়।
আড়াই বছর আগে শর্ম অল শেখের পরে এই ভাবে আরও এক বার পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে বাজি ধরতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
শর্ম অল শেখে নির্জোট সম্মেলনের ফাঁকে নতুন করে এই প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন মনমোহন। এবং ২৬/১১ সত্ত্বেও। কিন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং আইএসআইয়ের অতি-সক্রিয় ভূমিকায় প্রধানমন্ত্রীর সেই শান্তি প্রক্রিয়া নানা ভাবে ব্যাহত হয়েছে। তাতেও নিজের অবস্থানে অটল থেকে আরও এক বার শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়ে উদ্যোগী প্রধানমন্ত্রী। পনেরোতম নির্জোট সম্মেলনের পরে এ বার সতেরোতম সার্ক সম্মেলনে।
মলদ্বীপে দু’দিনের সার্ক সম্মেলন শুরু হচ্ছে ১১ নভেম্বর থেকে। ওই দিনই সম্মেলনের ফাঁকে ইউসুফ রাজা গিলানির সঙ্গে ফের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসতে চলেছেন মনমোহন। সেখানে বিতর্কিত সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা। কাশ্মীর নিয়ে আলোচনাতেও আপত্তি নেই মনমোহনের। কাশ্মীরে স্বায়ত্তশাসনের প্রকৃতি কেমন হবে, তা নিয়ে একটি বিচারবিভাগীয় কমিশন গঠনের প্রস্তাব রয়েছে। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রে জানা যাচ্ছে, সেই বিষয়টি নিয়ে গিলানির সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন মনমোহন।
এই বৈঠকের পরে খুব শীঘ্রই দু’দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা আলোচনায় বসবেন। ভিসা নিয়ে দু’দেশের মধ্যে প্রোটোকলও খুব শীঘ্রই স্বাক্ষরিত হবে। দু’দেশের স্বরাষ্ট্রসচিবরা ইতিমধ্যে আলোচনা করে ভিসা নিয়ে চুক্তিটির খসড়া প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছেন। দু’দেশের ক্ষেত্রেই ভিসা ব্যবস্থাকে শিথিল করা হচ্ছে। সীমান্তের দু’পারের ব্যবসায়ীরাই এক বারে এক বছরের জন্য ‘মাল্টিপল ভিসা’ পেতে চলেছেন। যাঁরা এত কাল নব্বই দিনের ভিসা পেতেন, তাঁরা এ বার থেকে ছ’মাসের ভিসা পাবেন। আর যাঁরা এত দিন ছ’মাসের ভিসা পেতেন, তাঁরা পাবেন এক বছরের। এর ফলে বাণিজ্য সংক্রান্ত যোগাযোগ বাড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা। দু’দেশের বাণিজ্যমন্ত্রীদের মধ্যেও বৈঠক হতে চলেছে। পাকিস্তান ইতিমধ্যেই ভারতকে ‘মোস্ট ফেভারড নেশন’-এর (এমএফএন) মর্যাদা দিতে নীতিগত ভাবে রাজি হয়েছে। যদিও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় বিষয়টি এখন তারা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে চাইছে না। তবে সার্কে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর পাকিস্তান আনুষ্ঠনিক ভাবে বিষয়টি ঘোষণা করতে চলেছে। আসলে দেশে যাঁরা এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, সেই সেনাবাহিনী, আইএসআই এবং কট্টরপন্থীদের গিলানি দেখাতে চান, ভারতকে কাশ্মীর নিয়ে আলোচনায় বসানো গিয়েছে। এখন তাই তাদের এমএফএন-এর মর্যাদা দেওয়া যায়। তার আগে আপাতত গিলানি দেশের বাণিজ্য মন্ত্রককে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি পর্যটক ও তীর্থযাত্রীদের দ্বিগুণ সংখ্যায় অনুমতি দেওয়ার কথাও ভাবছে দু’দেশ। এ সব ছাড়াও সিয়াচেন ও স্যার ক্রিক নিয়ে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে আলোচনা হওয়ার কথা।
দু’দেশের মধ্যে ‘ট্র্যাক টু’ কূটনীতির মাধ্যমে মনমোহনের শান্তি প্রক্রিয়ার একটি পথ-নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছে। সেই পথ-নির্দেশিকা অনুসারে প্রধানমন্ত্রী ২০১২ সালে পাকিস্তান সফরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অটলবিহারী বাজপেয়ী ১৯৯৯ সালে ‘শান্তির বাস’ নিয়ে লাহৌরে গিয়েছিলেন। তার পর কার্গিল যুদ্ধ হয়েছে। তা সত্ত্বেও আবার ২০০৪ সালে সার্ক সম্মেলন উপলক্ষে ইসলামাবাদে গিয়ে পারভেজ মুশারফের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছিলেন বাজপেয়ী। সেই বৈঠকের পর একটি যৌথ বিবৃতি জারি করা হয়েছিল। সেই যৌথ বিবৃতিটি এখনও ভারত-পাক সাম্প্রতিক মৈত্রীর ভিত্তি প্রস্তর। শর্ম অল শেখের বিবৃতিটিও সেই বিবৃতির উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। ১৯৮৮ সালে রাজীব গাঁধী কংগ্রেসের শেষ প্রধানমন্ত্রী, যিনি পাকিস্তানে গিয়ে শান্তি প্রক্রিয়ায় উদ্যোগী হয়েছিলেন।
ইতিহাসের এই পথ ধরে আগামী বছর পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন মনমোহন। তাঁর পরিকল্পনা রয়েছে, উত্তরপ্রদেশে ভোট চুকলে আগামী বছর জুলাইয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়ে গেলে সেপ্টেম্বরের গোড়ায় যেতে পারেন পাকিস্তানে। ওই মাসের শেষ সপ্তাহে রাষ্ট্রপুঞ্জের বৈঠকের আগে ওই সফর হতে পারে বলে জানা গিয়েছে।
এমন এক পরিস্থিতিতে আসন্ন বৈঠকটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ, কাশ্মীর প্রসঙ্গে আলোচনা হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে বলে। ইতিমধ্যেই দিলীপ পদগাঁওকরের নেতৃত্বে কাশ্মীর নিয়ে গঠিত কমিটি রিপোর্ট পেশ করেছে। সেই রিপোর্টেও কাশ্মীরের মর্যাদা নিয়ে বিচারবিভাগীয় কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। দিলীপ ছাড়াও ওই কমিটির সদস্য হলেন রাধাকুমার এবং এম এম আনসারি। কাশ্মীরে হুরিয়ত নেতাদের মূল দাবি, ’৫২ সালের আগে কাশ্মীরে যে স্বায়ত্তশাসন জারি ছিল, তা-ই ফিরিয়ে আনতে হবে। সেই আইন পরে কেন্দ্র সংশোধন করে। বস্তুত, যে বিচারবিভাগীয় কমিশন গঠনের কথা হচ্ছে, তাদের কাজ হবে বিষয়টি নতুন করে পর্যালোচনা করা। বাজপেয়ী জমানায় তৎকালীন উপ-প্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণী হুরিয়তের সঙ্গে ’৫২ পূর্ববর্তী মর্যাদা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু তা শেষ হওয়ার আগেই ভোট এসে যায়। এবং দিল্লিতে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে। ইউপিএ-র প্রথম জমানায় এ জি নুরানি এ বিষয়ে একটি ‘নন-পেপার’ পেশ করেন মনমোহনের কাছে। সেটি নিয়ে মুশারফের সঙ্গেও দেখা করেছিলেন নুরানি। তাঁর প্রস্তাব ছিল, দুই কাশ্মীর নিয়ে যুগ্ম পরিষদ গঠন করা হোক, যাতে সেখানে অবাধ বাণিজ্য ও যাতায়াত সম্ভব হয়। আর ওই যুগ্ম পরিষদের শীর্ষ পদটির দায়িত্ব পর্যায়ক্রমে দু’তরফের হাতে থাকবে।
মনমোহন-গিলানি দু’পক্ষই এখন আলাপ-আলোচনায় আগ্রহী। দেশে মূল্যবৃদ্ধি থেকে দুর্নীতি, সব প্রশ্নে ইউপিএ সরকারের যখন নাস্তানাবুদ অবস্থা, তখন ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে ভারত-পাকিস্তান মৈত্রীকে একটি বড় জাতীয় আলোচ্য-সূচিতে পরিণত করতে চাইছেন মনমোহন। যদিও পাকিস্তান-কূটনীতি কী হবে, মনমোহন সরকারের মধ্যে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী নটবর সিংহ থেকে বর্তমান অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়, কেউই পাকিস্তানের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কূটনীতিতে বিশ্বাস করেন না। বরং তাঁরা মনে করেন, এটা ম্যারাথন দৌড়। তাই ধীরে সুস্থে এগোনোই ভাল। কিন্তু মনমোহন সিংহ পঞ্চ নদের তীরের বাসিন্দা। জন্মসূত্রে তাঁর শিকড় পাকিস্তানে। তাই মনমোহন এই চ্যালেঞ্জ নিচ্ছেন। যদিও পাকিস্তানকে নিয়ে এই বাজি এর আগে ইন্দিরা গাঁধী থেকে শুরু করে সমস্ত রাষ্ট্রনায়কই ধরেছেন।
কিন্তু পাকিস্তান ব্যগ্র কেন?
পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা জারি রয়েছে। একে তো জারদারি-গিলানির বিরোধ সুবিদিত। তার উপরে প্রভাবশালী পঞ্জাব লবির জোরে বিরোধী নওয়াজ শরিফও যথেষ্ট শক্তিশালী। সক্রিয় রয়েছেন পারভেজ মুশারফও। এরই মধ্যে জারদারি-গিলানি প্রশাসন নীতিগত ভাবে ভারতকে ‘মোস্ট ফেভারড নেশন’-এর মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি মেনে নেওয়ায় সেনাবাহিনী, আইএসআই বা কট্টরবাদী হুরিয়ত নেতারা ক্ষুব্ধ। তাদের বক্তব্য, কাশ্মীর নিয়ে ভারতের কাছ থেকে কোনও কিছু পাওয়ার আগেই কেন ওই মর্যাদা দেওয়া হল? তাই গিলানি প্রকাশ্যে বলছেন, ভারতকে এখনও ওই মর্যাদা দেওয়া হয়নি। যদিও বাস্তব পরিস্তিতি হল, সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে। সে কথা ভারতকে জানিয়েও দিয়েছে পাকিস্তান। বাণিজ্যমন্ত্রীদের বৈঠকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পাক বিদেশমন্ত্রী হিনা রব্বানি খারও আজ দাবি করেছেন, এমএফএন নিয়ে পিছিয়ে যাবে না পাকিস্তান। একই সঙ্গে তিনি জানান, ভারতের সঙ্গে শান্তি বৈঠকে পাক সেনাবাহিনীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তারাও শান্তি আলোচনাকে সমর্থন করেছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আবার নিজেদের আফগান-নীতির জন্য আমেরিকার কোপে পড়েছে পাকিস্তান। আর লাদেন-হত্যার পর তো তারা এখন কাঠগড়ায়।
তাই মনমোহনের সঙ্গে বৈঠকেই কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা শুরু করতে চাইছে পাকিস্তান। সুষ্ঠু আলোচনার বাতাবরণ তৈরির লক্ষ্যে এর মধ্যেই পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ঢুকে পড়া সেনা কপ্টারকে ছেড়ে দিয়ে সদর্থক বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছে ইসলামাবাদ। তবে দিল্লির দিক থেকে একটি প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তা হল, পাকিস্তানের সঙ্গে আবার শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করে যে বাজি ধরেছেন মনমোহন, তা কি ইতিবাচক দিকে এগোবে? ১১ নভেম্বরের আগে সে কথা হলফ করে বলতে পারছেন না দিল্লির কূটনীতিকরাও।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.