কেন্দ্রীয় সরকারের উপর তাঁর ‘চাপ’ বজায় রাখছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সে বিদেশ থেকে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বা তাঁর শহরে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় যতই পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে ‘যুক্তি’ দিন না কেন!
শনিবার ইউপিএ-র দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিকের সর্বময় নেত্রী মমতা সাফ বলেছেন, “আমরা এ সব মানছি না! প্রধানমন্ত্রী যা বলার বলেছেন। কিন্তু আমরাও আমাদের বক্তব্য জানিয়ে দিয়েছি। এর পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত নেব। কিন্তু মানুষের স্বার্থের বিষয়ে আমরা কোনও আপস করব না।”
প্রত্যাশিত ভাবেই, আগামী ২১ নভেম্বর রান্নার গ্যাস এবং ডিজেলের দাম বাড়ানোর যে কেন্দ্রীয় প্রস্তাব রয়েছে, মমতা তারও বিরোধিতা করবেন। সেই সিদ্ধান্ত যাতে কার্যকর না-হয়, সে জন্যই তৃণমূল নেত্রীর কেন্দ্রের উপর নিরন্তর ‘চাপ’ রেখে যেতে চাইছেন বলে দলীয় সূত্রের খবর।
ঘটনাচক্রে, ইউপিএ-র অন্যান্য শরিকও পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরব হয়েছে। এমনকী, ঠেকায় পড়ে ‘অন্যরকম’ বলতে বাধ্য হচ্ছে কংগ্রেসও। তৃণমূলের কাছে সেটাও যথেষ্ট ‘ইতিবাচক’ দিক। দলের নেতারা মনে করছেন, এর ফলে তাঁদের প্রতিবাদ আরও গতি পাচ্ছে। পাশাপাশি, জনমানসে ‘উজ্জ্বল’ হচ্ছে তাঁদের ভাবমূর্তি। আক্রমণ ভোঁতা হচ্ছে সিপিএমের।
তবে পুরো ঘটনাপ্রবাহে প্রণববাবুর উপর যথেষ্ট ‘ক্ষুব্ধ’ তৃণমূল। পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির যে ব্যাখ্যা এ দিন তিনি কলকাতার একটি অনুষ্ঠানে দিয়েছেন, তা প্রত্যাশিত ভাবেই মমতার কাছে পৌঁছেছে। প্রকাশ্যে ওই বিষয়ে তৃণমূল নেত্রী কোনও মন্তব্য করেননি। শুধু সংক্ষিপ্ত ভাবে বলেছেন, “আমাদের ধমক দিয়ে কোনও লাভ নেই!” তবে এ দিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কুমারী শৈলজার সঙ্গে মহাকরণের বৈঠকে ঘরোয়া ভাবে ওই বিষয়ে তিনি ‘অনুযোগ’ জানিয়েছেন বলেই প্রশাসনিক সূত্রের খবর। প্রসঙ্গত, শুক্রবারই তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আনন্দ শর্মা। তাঁর কাছেও প্রণববাবুর ‘ভূমিকা’ নিয়ে ঈষৎ ক্ষোভ ব্যক্ত করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। সেই জন্যই পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির এই পর্যায়ে প্রণববাবুর সঙ্গে আর (বৃহস্পতিবার রাতে দলের মন্ত্রী মুকুল রায়ের একটি ফোন ছাড়া) যোগাযোগ করছে না তৃণমূল। সরাসরি যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর দরবারে।
‘অবিচল’ প্রণববাবু অবশ্য এ দিন কলকাতায় বলেছেন, “কাগজে দেখলাম, আমাদের গুরুত্বপূর্ণ শরিক তৃণমূল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চায়। আমার ধারণা, ওই আলোচনা হলে সমস্যা মিটবে। ইউপিএ-র যে কোনও শরিক যে কোনও বিষয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাও করতে পারে। তারাও (তৃণমূল) তা-ই করেছে। বলেছে, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পরে তাঁকে তাদের কথা জানাবে। আমি এতে ভুল কিছু দেখছি না।”
দলের তরফে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিনই প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে যোগাযোগ করে ৮ বা ৯ তারিখ তৃণমূলের প্রতিনিধিদল নিয়ে দেখা করতে চেয়েছেন। সুদীপবাবু জানান, ৭ তারিখ বকর-ই-ইদ। সে দিন সাংসদদের এলাকায় থাকতে হবে। ফলে সে দিন দিল্লি গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হবে না। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে তাঁকে জানানো হয়েছে, ৯ তারিখ প্রধানমন্ত্রীর আবার দেশের বাইরে যাওয়ার কথা। সুদীপবাবুর কথায়, “সে ক্ষেত্রে আমরা আশা করছি, আগামী ৮ তারিখ, মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী আমাদের সময় দেবেন। আমরা আমাদের সংসদীয় দলের অভিমত (পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ জানিয়ে সরকার ছেড়ে বেরিয়ে-আসা) এবং আমাদের দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকার কথা প্রধানমন্ত্রীকে জানাব। তার পর বল ওঁর কোর্টে।”
বস্তুত, মমতাও সংসদীয় দলকে সেই নির্দেশই দিয়েছেন। তিনি দলের সাংসদদের বলেছেন, তাঁরা যেন প্রধানমন্ত্রীকে স্রেফ তাঁদের বক্তব্য জানিয়ে চলে আসেন। ইউপিএ-র দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিকের নেত্রীর মনোভাব থেকে স্পষ্ট যে, পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি (আরও বেশি করে যে পদ্ধতিতে ওই দাম বাড়ানো হয়েছে) নিয়ে তিনি কোনওরকম ‘আপস’-এর রাস্তায় এখনও হাঁটতে চাইছেন না। মমতার কথায়, “ওঁরা (প্রধানমন্ত্রী) শুধু সরকার চালানোর দায়িত্ব পালন করছেন। জনগণের প্রতি কোনও দায়িত্ব পালন করছে না! আমরা এত দিন অনেক হজম করেছি! কাউকে না কাউকে তো বেড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধতেই হত। সেই কাজটা না-হয় আমরাই করলাম!”
মূলত সেই জন্যই প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সংসদীয় দলের তরফে বলা হবে, রান্নার গ্যাস এবং ডিজেলের দাম না-বাড়াতে। এমন প্রস্তাবও রয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করা হবে, পেট্রোলে লিটার প্রতি যে ১ টাকা ৮২ পয়সা দাম বাড়ানো হয়েছে, ডিজেলের দাম যেন লিটারে ততটাই কমিয়ে দেওয়া হয়। তৃণমূলের এক শীর্ষনেতার কথায়, “পেট্রোলের বর্ধিত দাম চালু হয়ে গিয়েছে। সেটা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলেই সরকারের দাবি। কিন্তু ডিজেলের দাম তো এখনও সরকারই নিয়ন্ত্রণ করে। সেই দামটা বরং কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে। তাতে গোটা সমস্যার একটা সর্বজনগ্রাহ্য সমাধানসূত্র বেরোয়।”
সুদীপবাবুর কথায়, “স্বচ্ছতার সঙ্গে আমাদের মনোভাবের কথা প্রধানমন্ত্রীকে পুঙ্খানুপুঙ্খ জানাব। তিনি অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কী ভাবে তার ব্যাখ্যা করবেন, সেটা তাঁর নিজস্ব ব্যাপার। আমরা আমাদের কথাটা বলে আসব।”
পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি তো বটেই, মমতা আরও ‘ক্ষুব্ধ’ যে ভাবে তাঁদের সঙ্গে কোনও আলোচনা ছাড়াই ‘একতরফা’ ভাবে ওই দাম বাড়ানো হচ্ছে, তা নিয়ে। তাঁর বক্তব্য, তাঁদের শরিকের ‘প্রাপ্য মর্যাদা’ দেওয়া হচ্ছে না। যে মনোভাবের প্রতিধ্বনি করে সুদীপবাবু বলেছেন, “সিদ্ধান্ত হোক আলোচনার মাধ্যমে। দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিককে তার প্রাপ্য মর্যাদাটা দেওয়া হোক! এ ভাবে একতরফা মূল্যবৃদ্ধি হতে পারে না।” সেই প্রেক্ষিতেই তৃণমূলের প্রতিনিধিদলের তরফে প্রধানমন্ত্রীকে প্রস্তাব দেওয়া হবে ইউপিএ-২ সরকারেও একটি ‘সমণ্বয় কমিটি’ গড়া হোক। যে কমিটি এক বা দু’মাস অন্তর অন্তর বৈঠকে বসবে।
তৃণমূলের একাংশের মতে, মমতা চান কেন্দ্রীয় সরকারের উপর ‘চাপ’ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করতে। পাশাপাশি, আমজনতার কাছে এই বার্তা দিতে যে, কোনওরকম ‘জন-বিরোধী’ সিদ্ধান্তের সঙ্গে তিনি আপস করতে রাজি নন। সে সরকার ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হলেও। মমতা নিজে মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন ব্যক্তিগত ভাবে ‘সৎ এবং পরিচ্ছন্ন’। কিন্তু তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ‘দুর্বল’। যে কারণে তাঁর সরকার বিভিন্ন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। বস্তুত, বিভিন্ন দুর্নীতি ও মূল্যবৃদ্ধি সংক্রান্ত গোলমালে জড়িয়ে-পড়া ইউপিএ সরকার মমতার কাছে উত্তরোত্তর ‘বোঝা’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে দলের একাংশ মনে করছে। কিন্তু এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যও মমতার দরকার। ঠিক যে ভাবে কেন্দ্রেরও তাঁকে প্রয়োজন সরকার টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু ঘনিষ্ঠমহলে মমতা এটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ইউপিএ-র ‘জন-বিরোধী’ সিদ্ধান্তের পাশে তিনি নেই। বরং তিনি সেই প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে ‘দূরত্ব’ বাড়াবেন। সেটা মমতার কাছে জরুরিও বটে। কারণ তাঁর নিজস্ব রাজনীতি বরাবরই ‘জনমুখী’ পথে চলেছে। যে কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিয়ে দৈনিক প্রবল চাপের মুখে পড়েও মুখ্যমন্ত্রী মমতা সেই সিদ্ধান্ত এখনও নেননি। দলের এক সাংসদ এ দিন তা জানিয়ে বলেন, “বললেই কি দাম বাড়িয়ে দিতে হবে নাকি? সরকারের সদিচ্ছা এবং আমজনতার উপর বোঝা চাপানোর ইচ্ছে না-থাকলে যে তা করেও দেখানো যায়, তা তো আমাদের নেত্রী নিজেই দেখাচ্ছেন! বিদ্যুতের দাম তো বটেই, তিনি এখনও বাস-মিনিবাস-ট্যাক্সির ভাড়াও বাড়াতে দেননি!”
শুক্রবার বিকেলে সংসদীয় দলের সঙ্গে আলোচনা এবং তার পর মমতার তরফে কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘চরম হুঁশিয়ারি’ দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তৃণমূল শিবিরে খবর আসে, প্রধানমন্ত্রী বিদেশে বসে পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি এবং ডিজেল-সহ পেট্রোপণ্যের প্রস্তাবিত মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে কী বলেছেন। রাতেই ওই বিষয়ে বিশদে খোঁজখবর শুরু করে তৃণমূল শিবির। এ দিন সকালেই দলের এক প্রথম সারির নেতা বলেন, “বিষয়টা অত সহজে মিটবে বলে মনে হচ্ছে না। বিশেষত, প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের পর।” দলনেত্রী তো বটেই, একাধিক সাংসদ মনে করছেন, পরিকল্পনা মতো রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি কমিয়ে দাম বাড়ালে এবং ডিজেলেরও মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে তৃণমূলের পক্ষে মন্ত্রিসভায় থাকা খানিকটা কঠিন হবে। এক সাংসদের কথায়, “মমতা’দি বিষয়টা যে পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন, তাতে কেন্দ্রীয় সরকার রান্নার গ্যাস আর ডিজেলের দাম বাড়ালে আমাদের হাতে অন্য কোনও উপায় থাকবে না।”
তৃণমূল নেতৃত্বের একটি অংশের অবশ্য এখনও আশা, শেষ পর্যন্ত তাঁদের ‘চরম’ কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হবে না। তার আগেই কোনও ‘সমঝোতাসূত্র’ বেরোবে। অন্তত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তৃণমূলের প্রতিনিধিদল দেখা করলে গোটা পরিস্থিতির পক্ষে ‘ইতিবাচক’ কিছু ঘটবে বলেই তাঁদের আশা।
তত দিন পর্যন্ত দুই ‘এম’ (মনমোহন-মমতা)-এর স্নায়ুযুদ্ধ জারি রইল।
|