দু’বছর আগে শরিকদের সঙ্গে পরামর্শ করেই পেট্রোলের নিয়ন্ত্রণমুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইউপিএ সরকার। তৃণমূলের নাম না-করে শনিবার এ ভাবেই পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে তাদের আপত্তি ওড়ালেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে যা কার্যত বামেদের অভিযোগেরই প্রতিধ্বনি।
বৃহস্পতিবার পেট্রোলের দাম ফের এক দফা বাড়ার পরে শুক্রবার উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ছেড়ে সরে আসার ইঙ্গিতে কংগ্রেসের উপরে চাপ সৃষ্টি করে জানিয়েছিলেন, বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন তিনি। সেই চাপ সত্ত্বেও মনমোহন সিংহ অবশ্য সে দিনই জানিয়ে দেন, তিনি সামগ্রিক ভাবে পেট্রোপণ্যের বিনিয়ন্ত্রণের পক্ষে। শনিবার সরকারের সেই অনড় অবস্থান বজায় রেখে প্রণববাবুও কৌশলে মনে করিয়ে দিলেন যে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় শরিকদের সঙ্গে আলোচনা করেই ২০১০-এর ২৮ জুন পেট্রোলের উপর থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেই অনুযায়ী, এর পর থেকে তেল সংস্থাগুলি দাম বাড়িয়েছে। ডিজেলের নিয়ন্ত্রণ মুক্তির সুপারিশ থাকলেও তা এখনই কার্যকর হবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিলে ওই বৈঠকে। সিপিএমের প্রকাশ কারাট, বৃন্দা কারাট-সহ বিরোধীরাও দাম বৃদ্ধি নিয়ে তৃণমূলকে বিঁধতে
|
কৌশিক বসু |
গিয়ে নিয়ন্ত্রণ-মুক্তির সিদ্ধান্তের সময় তাদের উপস্থিতির প্রসঙ্গই তুলছে। উল্লেখ্য, তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় তৃণমূলের একমাত্র পূর্ণমন্ত্রী ছিলেন মমতা নিজেই।
শুধু তৃণমূলকে সরকারি সিদ্ধান্তের শরিক করা নয়, বাস্তবে তেলের দাম বাড়ানো যে সত্যিই দরকার, তার পক্ষেও এ দিন সওয়াল করেছেন প্রণববাবু ও তাঁর মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৌশিক বসু। শনিবার ওয়েস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস-এ সপ্তম ‘কেশবচন্দ্র বসু স্মারক বক্তৃতা’ দিতে কলকাতা এসেছিলেন প্রণববাবু। সেই অনুষ্ঠানের পরে সাংবাদিক বৈঠকে নিজেই তেলের দাম বৃদ্ধির প্রসঙ্গ তোলেন তিনি। বলেন, রাজনৈতিক দলগুলি আর্থিক যুক্তির কথা কানে নেয় না। জনপ্রিয় হতেই দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানায়। তাতে আমজনতারই ক্ষতি হয়। কারণ, ভর্তুকির দাম কখনও না কখনও দিতে হয় তাদেরই। শরিকদের সঙ্গে আলোচনা না করেই কংগ্রেস কোনও কোনও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়, এই অভিযোগও এ দিন খণ্ডন করেছেন প্রণববাবু। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য, তাঁর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিগোষ্ঠীর (এমপাওয়ার্ড গ্রুপ অফ মিনিস্টার্স) সদস্য শরিক দলগুলিও। কিন্তু সেই মন্ত্রিগোষ্ঠীর সভায় সকলে সব সময় হাজির থাকেন না বলেও কার্যত ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
তেলে ভর্তুকি তোলার ব্যাপারে অর্থমন্ত্রীর যুক্তিতেই এ দিন সায় দেন কৌশিক বসু। ভারত চেম্বারের এক সভার ফাঁকে তেল ব্যবসার দরজা আরও বেশি করে বেসরকারি সংস্থার জন্য খুলে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করে তিনি বলেন, কোষাগারের উপর চাপ কমাতে বেসরকারি ক্ষেত্রের সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির প্রতিযোগিতা জরুরি। উদাহরণ হিসেবে তিনি অসামরিক বিমান পরিষেবা ক্ষেত্রে এক সময় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির প্রাধান্য এবং পরে প্রতিযোগিতার ফলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের সার্বিক উন্নতির (যেমন দাম কমা, পরিষেবার সংখ্যা ও উন্নতি) উদাহরণ দেন। |
অন্য দিকে বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পণ্য ও পরিষেবার দাম ঠিক হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রেও বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করেন প্রণববাবু। উল্লেখ্য, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিরও বিরোধী পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তাদের আপত্তিতেই বিপুল ক্ষতি সত্ত্বেও মাসুল বাড়ানোর জন্য নিয়ন্ত্রণ কমিশনের কাছে আবেদন জানাতে পারেনি বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থাগুলি। প্রণববাবু বলেন, দেশে তেলের চাহিদার ৭৫ শতাংশই আমদানি করতে হয়। এইচপিসিএল এবং বিপিসিএল-এর চলতি অর্থ বর্ষে ১২ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। ইন্ডিয়ান অয়েল-ও লোকসানের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আগামী দিনে সংস্থাগুলি কোথা থেকে তেল আমদানির টাকা জোগাড় করবে, সেই প্রশ্ন তোলেন প্রণববাবু। তাঁর হিসেবে, তেল সংস্থাগুলিকে গত বছর ৭৮১৯০ কোটি টাকা ভর্তুকি (আন্ডার রিকভারি) দিয়েছিল কেন্দ্র। এ বার তা বেড়ে হবে ১.৩২ লক্ষ কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, গত অর্থ বর্ষে ভর্তুকি খাতে কেন্দ্রের মোট খরচ হয়েছিল ১ লক্ষ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। ক্রমবর্ধমান ভর্তুকি কত দিন দেওয়া সম্ভব, এই প্রশ্ন তুলে প্রণববাবু বলেন, ভর্তুকি বাড়ার অর্থ উন্নয়নের টাকায় টান পড়া। ফলে উন্নয়নের স্বার্থেই যে জনমোহিনী পথ থেকে সরে আসা ছাড়া উপায় নেই, সে কথাই এ দিন বারবার বোঝাতে চেয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। তাঁর মতে, ভর্তুকিতে যে বিপুল টাকা খরচ হয়, তা পরিকাঠামো উন্নয়নে খরচ করলে আখেরে তার ফল সবাই ভোগ করবে। যেমন চাষির ঘরে শস্য আছে। কিন্তু বাজার ফাঁকা। তার মূলে রয়েছে হিমঘরের মতো পরিকাঠামোর অভাব। এই খামতি মেটাতেই টাকার প্রয়োজন। ভর্তুকি দিয়ে দেশ চালালে এই কাজ করা সম্ভব হবে না। নাগরিককেই তার মূল্য দিতে হবে।
কিন্তু রাজ্য সরকার কি কর কমিয়ে আমজনতাকে রেহাই দিতে পারে না? সম্ভাব্য বিতর্কের আশঙ্কায় এই প্রশ্নের জবাবে প্রণববাবু বলেন, “এটা আমি বললে তো রাজ্যগুলি বলবে, তা হলে আমরা কোথা থেকে আয় করব?” তবে এর পরই পরিসংখ্যান দিয়ে তাঁর দাবি, কেন্দ্রীয় করের এক-তৃতীয়াংশ যায় রাজ্যগুলির কোষাগারেই। ফলে রাজ্যগুলি প্রকৃত অর্থে কর বাবদ বেশি আয় করে থাকে। তিনি বলেন, “এক বছরের হিসেবে দেখেছি, অশোধিত তেলের উপর কর চাপিয়ে কেন্দ্রের আয় হয় ৯৬ হাজার কোটি টাকা। আর রাজ্যগুলির আয় হয় ৮৪ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু কেন্দ্রের আয়ের এক-তৃতীয়াংশ আবার চলে যায় ২৮টি রাজ্যের হাতে। অর্থাৎ, কেন্দ্রের প্রকৃতি আয় অনেক কম হয়।”
নাম না-করে তৃণমূলের নালিশ উড়িয়ে দিলেও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কথা মাথায় রেখে তাদের ক্ষোভ ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত ‘স্বাভাবিক’ বলেই শনিবার মন্তব্য করেছেন প্রণববাবু। যে কোনও রাজনৈতিক দলই একই কাজ করত, এই যুক্তিতে জোট সঙ্গীর আচরণে কোনও রকম ‘ভুল’ দেখছেন না কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী।
|