তেলের দামের উপর থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ তোলার নীতিতে তিনি অনড়। আজ কলকাতায় সেই নীতির পক্ষে জোর সওয়ালও করেছেন তাঁর অর্থমন্ত্রী। কিন্তু একই সঙ্গে জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় ‘ক্ষুব্ধ’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শান্ত করতে সক্রিয় হলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। মনমোহন চাইছেন, আর্থিক সাহায্য নিয়ে মমতার যা দাবিদাওয়া, তা মিটিয়ে যদি তাঁর মানভঞ্জন করা যায়। তৃণমূলের প্রতিনিধি দলের সঙ্গেও শীঘ্রই কথা বলবেন তিনি।
আজ সকাল ৮টায় কান থেকে দিল্লি পৌঁছেই প্রধানমন্ত্রী কথা বলেন ক্যাবিনেট সচিব এবং আর্থিক উপদেষ্টাদের সঙ্গে। অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ও আজ দুপুরেই দিল্লি ফিরে আসেন। তাঁর সঙ্গেও সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো যাতে কোনও বাধা না হয়, সে জন্য এই রাজ্যের মতোই ঋণ জালে জড়িয়ে থাকা পঞ্জাব ও কেরলকেও একই রকম সাহায্য দিতে চান তিনি।
জি ২০-তে গ্রিসের জন্য ইউরোপের ত্রাণ প্যাকেজ নিয়ে আলোচনা সেরে দেশে ফিরেই পশ্চিমবঙ্গের ‘ত্রাণ প্যাকেজ’ নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন প্রধানমন্ত্রী। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের মতে, গ্রিস এবং পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক পরিস্থিতির একটা লক্ষ্যণীয় মিল রয়েছে। গ্রিস বিপুল পরিমাণ অর্থ ধার নিয়ে বছরের পর বছর ভর্তুকি দিয়েছে। জনমোহিনী প্রকল্পে খরচ করেছে। সেই একই পথে হেঁটেছে পশ্চিমবঙ্গও। ফলে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, পেনশন, ঋণের সুদ আর ভর্তুকি দিতেই প্রায় সব টাকা ফুরিয়ে যায়। উন্নয়নের জন্য টাকা বলতে গেলে থাকেই না। ফলে আবার ঋণ নিতে হয়। এই ভাবে প্রায় দু’লক্ষ কোটি টাকা ঋণের বিষচক্রে আটকে পড়ছে রাজ্য। মমতার বক্তব্য, এই পরিস্থিতির জন্য তিনি দায়ী নন। গত ৩৪ বছর ধরে রাজ্যের অর্থনীতির এই অধঃপতন হয়েছে। সে ক্ষেত্রে কেন্দ্র কেন রাজ্যকে আর্থিক শৃঙ্খলার ব্যাপারে আগেই সতর্ক করেনি? মমতা প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, “ইতিহাসের এই বোঝা আমি একা কেন বইব? কেন্দ্রকেও বইতে হবে।” প্রধানমন্ত্রীও মনে করছেন, বিশেষ অর্থসাহায্য চাওয়ার পিছনে মমতার যুক্তি গ্রহণযোগ্য। কিন্তু কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক এখনও পর্যন্ত রাজ্যকে যে অর্থ সাহায্যের কথা বলেছে, তার সবটাই প্রকল্পভিত্তিক। দৈনন্দিন খরচ চালানোর টাকা তার নেই।
প্রণববাবু রাজ্যকে অর্থ সাহায্য দিতে অরাজি নন। কিন্তু তাঁর যুক্তি, অর্থ কমিশনের মূল্যায়ন অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে কেরল এবং পঞ্জাব এই তিনটি রাজ্যই সব চেয়ে বেশি ঋণ জর্জরিত। সে ক্ষেত্রে একটি রাজ্যকে দিলে অন্য দু’টি রাজ্য ক্ষুব্ধ হবে। কেরল কংগ্রেস-শাসিত। আর পঞ্জাব মনমোহনের নিজের রাজ্য। সে রাজ্যে আবার ভোট আসন্ন। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছেন, এ বার পঞ্জাবে দলের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
অতীতে ইন্দ্রকুমার গুজরাল যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন বিপুল অঙ্কের কৃষিঋণ মকুব করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন পঞ্জাবকে। সেই আশ্বাস কিন্তু আজও বাস্তবায়িত হয়নি।
আবার শুধু এই তিনটি রাজ্য নয়। জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের সাম্প্রতিক বৈঠকে জয়ললিতাও তামিলনাড়ুর জন্য আরও অনেক বেশি টাকা চেয়েছেন। এমনকী, মমতাকে কেন বেশি সাহায্য করা হয়েছে, তার কৈফিয়ৎ চেয়েছেন। এই অবস্থায় প্রণববাবু পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপারে এক পা এগিয়েও দু’পা পিছিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কথা স্মরণ করে।
প্রধানমন্ত্রী চান শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, কেরল এবং পঞ্জাব-এই দু’টি রাজ্যকেও বিশেষ আর্থিক সাহায্য দেওয়া হোক। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক যদি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় প্রস্তাব পাঠায় তবে তা অনুমোদন করা হবে। প্রণববাবুও বলেন, অর্থ কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যয়বরাদ্দ সচিব সুমিত বসুর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা খুব শীঘ্রই রিপোর্ট দেবে। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল মনে করছে, পশ্চিমবঙ্গ, কেরল এবং পঞ্জাব এই তিনটি রাজ্যকে একসঙ্গে প্যাকেজ দিলে কারওরই বলার কিছু থাকবে না।
পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক প্যাকেজ নিয়ে এই তৎপরতার কারণ গত কাল মমতার যে ভাবে পেট্রোলের দাম নিয়ে ফোঁস করে উঠেছেন, তাতে কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব অশনি সংকেত দেখছেন। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশকে মমতা বলেছেন, “সরকার ফেলে দেওয়া আমার লক্ষ্য নয়। কিন্তু দিল্লিতে বসে আপনারা বুঝতে পারছেন না, সাধারণ মানুষ কী বলছে? ১১ মাসে ১২ বার তেলের দাম বাড়ানো হবে এবং সেটা বেসরকারি সংস্থার সিদ্ধান্ত বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়াটা অপরাধ। সাধারণ মানুষের জানতে বাকি নেই যে, বেসরকারি সংস্থা সরকারের সঙ্গে কথা বলেই দাম বাড়ায়।” তৃণমূল নেত্রী আরও বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমে যাওয়ায় পাকিস্তানে তেলের দাম কমেছে। তা হলে ভারতে বাড়ছে কেন?
জয়রাম আজ প্রধানমন্ত্রীকে মমতার অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন। ঠিক হয়েছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তৃণমূলের সংসদীয় দলের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তেলের দাম নিয়ে আলোচনায় বসবেন। কংগ্রেস মুখপাত্র জনার্দন দ্বিবেদীও আজ বলেন, “সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন, এমন যে কোনও নীতিই পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। আমরাও চাই কিছু একটা সুরাহা হোক।”
কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের ধারণা, ২০১৪ সালের আগে মমতা ইউপিএ-র উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবেন না। কিন্তু তিনি ধীরে ধীরে ইউপিএ-র থেকে দূরত্ব রচনা করছেন। তৃণমূলের একাংশ চায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাকে বাইরে থেকে সমর্থন করা হোক। তা ছাড়া, রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন আসন্ন। এই অবস্থায় গোটা দেশে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মূল্যবৃদ্ধি থেকে দুর্নীতি বিভিন্ন বিষয়ে যে ভাবে জনমত তৈরি হচ্ছে, তা থেকে নিজেদের আলাদা রাখার প্রচেষ্টা তৃণমূলের দিক থেকে হতে পারে।
সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হতে চলেছে ২২ নভেম্বর থেকে। এ বারের অধিবেশনেও ইউপিএ শরিকদের সঙ্গে কংগ্রেসের ব্যাপক ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাই চাইছেন অধিবেশনের আগেই মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে তৃণমূলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে। বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি থেকে শুরু করে তৃণমূলের দলীয় অফিস পাওয়া না-পাওয়া, নানা বিষয়ে কংগ্রেস এবং তৃণমূলের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তা দূর করাই কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের অন্যতম লক্ষ্য। ঘটনাচক্রে আজই কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রী শৈলজা মমতার সঙ্গে মহাকরণে বৈঠক করেছেন। শৈলজা সনিয়া গাঁধীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। এর আগে অম্বিকা সোনিও মমতার সঙ্গে দেখা করেছেন। তবে ঠিক হয়েছে, মূলত জয়রামই এখন থেকে মমতার সরকার ও দিল্লির প্রধান যোগসূত্র হিসেবে কাজ করবেন।
|