|
|
|
|
পূর্ত-পরিবহণ নিয়ে জল্পনা, দল-প্রশাসনকে কাজে ডুবে থাকতে বললেন মমতা |
রাজ্য জয়ের পরে নজর জাতীয় স্তরে |
সঞ্জয় সিংহ • কলকাতা |
তৃতীয় বারের জন্য দলের সভানেত্রী নির্বাচিত।
তার থেকেও বড় কথা, বুধবার নেতাজি ইন্ডোরে তিন ভূমিকায় অবতীর্ণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রথম মমতা প্রশাসক। যিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ‘বার্তা’ দিলেন রাজ্য মন্ত্রিসভায় তাঁর সহকর্মীদের প্রতি।
দ্বিতীয় মমতা দলের সর্বময় নেত্রী। যিনি কড়া অনুশাসনের ‘হুঁশিয়ারি’ দিলেন দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে।
তৃতীয় মমতা আঞ্চলিক নেত্রী, যিনি জাতীয় স্তরে প্রতিষ্ঠাকামী। যিনি জানালেন, তাঁর লক্ষ্য জাতীয় রাজনীতিতেও নিজের এবং দলের জোরালো প্রাধান্য ‘প্রতিষ্ঠা’ করা।
গত দু’বারের মতোই সর্বসম্মত ভাবে মমতা নেতাজি ইন্ডোরে তৃণমূলের বিশেষ অধিবেশনে সর্বভারতীয় তৃণমূলের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। সেই মঞ্চ থেকে তিনি যে দলের মন্ত্রী এবং নেতাদের ‘বার্তা’ দেবেন, তা-ও প্রত্যাশিত ছিল। সেই ‘বার্তা’র নির্যাস নিজেদের শাসনক্ষমতা ব্যবহার করে, অসদুপায়ে অর্থ উপার্জন করা চলবে না। চলবে না প্রোমোটারি বা সিন্ডিকেট করাও। ‘ভোগ’ নয়, ‘ত্যাগ’ করতে হবে।
কিন্তু তার চেয়েও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ সম্ভবত মমতার স্পষ্ট ইঙ্গিত যে, আঞ্চলিক থেকে তিনি তৃণমূলকে প্রকৃত অর্থেই জাতীয় দলে পরিণত করতে চলেছেন। পরোক্ষে তাঁর জোটসঙ্গী কংগ্রেসের উদ্দেশে ‘বার্তা’ দিয়ে মমতা বলেন, “১৯৯৮ সালে দল প্রতিষ্ঠার পরে মাত্র ১ মাস ২২ দিনের মাথায় ভোটে দাঁড়িয়ে আমরা সাত জন সাংসদ হয়েছিলাম। গণনা কেন্দ্রে ঢোকার সময়েও সিপিএম ও তদানীন্তন কংগ্রেস আমাদের আঞ্চলিক দল বলে কটাক্ষ করেছিল। আরে জাতীয় দল হতে গেলে কী লাগে! অন্তত চারটে রাজ্যে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। ভোট বৃদ্ধি করতে হবে। উন্নততর দলীয় কর্মী তৈরি করতে হবে।” মমতা জানালেন, ত্রিপুরার ভোটে তাঁরা ‘জিতবেন’। অসম, অরুণাচলপ্রদেশ, আন্দামান ও মণিপুরের দলীয় নেতা-বিধায়কদের উপস্থিতিতে বললেন, “ওই রাজ্যগুলিতে আরও ভাল ফল করব।” |
পঞ্চ-মন্ত্র
• ক্ষমতা মানে ভোগ করা নয়। ত্যাগ করা।
• মন্ত্রী মানে টাকা কামানো নয়। কাজ করা।
• রাজধর্ম পালন করতে হবে।
• দলের কেউ প্রোমোটারি, সিন্ডিকেটের সঙ্গে থাকবে না।
• দলে গোষ্ঠীবাজি সহ্য করা হবে না। |
|
রাজ্য থেকে জাতীয় স্তরে চলার পথে তিনি যে সংগঠনকে কঠোর অনুশাসনের মধ্যে রাখতে চান, তা এ দিন স্পষ্ট করেছেন মমতা। বস্তুত, গত লোকসভার পর থেকেই দলকে তিনি ‘অনুশাসন পর্বে’র মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু জাতীয় দলে ‘উন্নততর কর্মী’র প্রয়োজন রয়েছে বলেই মুখ্যমন্ত্রী তাঁর দলীয় কর্মী থেকে মন্ত্রী সকলকে স্পষ্ট বলেছেন, “ক্ষমতা মানে ভোগ করা নয়। ত্যাগ করা। প্রচুর মানুষের রক্ত ঝরিয়ে, অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে সিপিএম হারাতে যে লড়াই হয়েছে, তাতেই জয় এসেছে। এই চলার পথে শপথ নিতে হবে, ক্ষমতা দখল করে নয়, ত্যাগের জন্য আমরা তৈরি থাকব।”
রাজ্যের মুখ্য প্রশাসক মমতা বলেছেন, “রাজধর্ম পালন করতে হবে। রাজধর্ম এত দিন বাংলায় ছিল না।” সু-প্রশাসন দিতে সরকারি ক্ষেত্রে ‘দুর্নীতি’কে যে তিনি প্রশ্রয় দেবেন না, তা বোঝাতে মন্ত্রীদের উদ্দেশে বলেন, “মন্ত্রী মানে টাকা কামানো নয়। কাজ করা। টাকা নিয়ে কাজ করতে আসিনি। টাকা নিয়ে কাজ করতে চাই না।” নিজের উদাহরণ দিয়ে মমতা জানান, তিনি বিধায়ক বা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বেতন নেন না। বেহালার এক বরো কমিটির চেয়ারম্যান সুশান্ত ঘোষ ও তাঁর সহকর্মী কাউন্সিলররা চার মাসের বেতন না নিয়ে সেই টাকা ‘মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে’ দান করেছেন জানিয়ে তাঁদের প্রশংসা করেন মুখ্যমন্ত্রী।
দলের সর্বময় নেত্রী মমতা জানিয়েছেন, সংগঠনকে ‘সুশৃঙ্খল’ করতে তিনি কোনও ‘গোষ্ঠীবাজি’কে বরদাস্ত করবেন না। তাঁর কথায়, “আমি নিজে কোনও গোষ্ঠী (গ্রুপ) করি না। কাউকে করতেও দেব না! দলে কোনও বিশৃঙ্খলা সহ্য করা হবে না। সে তিনি যত বড় মাপের নেতাই হোন না কেন!” দলের সর্বস্তরের কর্মীদের প্রতি তাঁর ‘সতর্কীকরণ’ “মনে রাখবেন, দলটা আছে বলেই আমরা মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ পাচ্ছি। জেলা থেকে ব্লক, প্রত্যেক ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে কোথায় কী হচ্ছে, তার খবর আমি রাখি।” দলে কেমন কর্মী চান, তা জানিয়ে মমতা বলেন, “আমি চাই, আমার সহকর্মীরা রাজনৈতিক ও উন্নততর মানুষ হোক। বিপদে-আপদে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।” কেমন কর্মী চান না? মমতার কথায়, “দলের কর্মীরা কেউ প্রোমোটারি বা সিন্ডিকেটের সঙ্গে থাকবে না। যারা এই সমস্ত কাজে যুক্ত থাকবে, তারা দলের কোনও পদে থাকতে পারবে না।” তাঁর আরও বক্তব্য, “সিপিএম যা করে, আমরা তা করি না। আমরা বন্দুক ধরে রাজনীতি করব না। অন্যায়-অত্যাচার করব না। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে।” আগামী দু’মাসে দলের কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচিও মমতা ঘোষণা করেন।
রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে জাতীয় স্তরে নিজেদের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে দিতে মমতার সঙ্গেই সচেষ্ট দলের বাকি নেতারাও। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগত রায়, দলের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী থেকে অসম, মণিপুর, অরুণাচল প্রদেশের তৃণমূল নেতা-বিধায়কদের বক্তব্যেও সেই বিষয়টি স্পষ্ট। বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় এবং সর্বসম্মত ভাবে এ বারও মমতা দলের সভানেত্রী হয়েছেন বলে ঘোষণা করেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়। তার অব্যবহিত পরেই সুদীপবাবু বলেন, “ভারতের রাজনৈতিক মহলে আমরা বার্তা দিচ্ছি, আজকের তৃণমূল সর্বভারতীয় দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে এবং ভারতের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হবে।”
শুভেন্দুও স্পষ্ট বলেন, “লোকসভা ভোট যখনই হোক, আগামী দিনে ভারতের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হবেন আমাদের নেত্রীই।” শুভেন্দুর বক্তব্যের সূত্র ধরে মণিপুর তৃণমূলের সভানেত্রী ও প্রাক্তন সাংসদ কিম গ্যানগেট বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে যেমন পরিবর্তন হয়েছে, একদিন ভারতেও পরিবর্তন হবে দিদির নেতৃত্বে।’’ অরুণাচল প্রদেশের তৃণমূল পরিষদীয় দলের নেতা লেটা এমব্রে বলেন, “জাতীয় রাজনীতিতে তৃণমূলই নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে।” এক ধাপ এগিয়ে অসমের তৃণমূল বিধায়ক দীপেন পাঠক সরাসরি বলেন, “দিদিকে আমরা শুধু বাংলার নেত্রী নয়, ভারতের নেত্রী হিসেবে দেখতে চাই।”
মমতাকে সভানেত্রী নির্বাচনের পর্ব মিটতেই বর্ধিত সভা হবে বলে ঘোষণা করেন মুকুলবাবু। সেই সভায় দলের সর্বভারতীয় কার্যকরী কমিটি গঠনের দায়িত্ব মমতার হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব আনেন সৌগতবাবু। সর্বসম্মত ভাবে সেই প্রস্তাবও গৃহীত হয়। সভায় দলের সমস্ত স্তরের নেতারাই উপস্তিত ছিলেন। উত্তর দিনাজপুরের প্রবীণ নেতা জয়নাল আবেদিন থেকে শুরু করে রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শিশির অধিকারী থেকে শুরু করে রাজ্যের তৃণমূল মন্ত্রীদের প্রায় সকলেই উপস্থিত চিলেন। মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বিদেশ সফরে রয়েছেন। তাই আসতে পারেননি। অসুস্থতার কারণে (মমতাকে তা জানিয়েও দিয়েছেন তিনি) আসতে পারেননি দলের প্রবীণ সাংসদ সোমেন মিত্রও।
ঘটনাচক্রে, পাঁচ বছর পর ২০১৬ সালে আবার তৃণমূলের সাংগঠনিক নির্বাচন হওয়ার কথা। ওই একই বছরে হওয়ার কথা পরের বিধানসভা ভোটও। তিন মমতা এ দিন যে তিনটি ‘বার্তা’ দিয়েছেন, ফলিত স্তরে তা কত দূর গিয়েছে, সেই বছরে তারও পরীক্ষা দিতে হবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী এবং জাতীয় স্তরে প্রতিষ্ঠাকামী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে! |
|
|
|
|
|