হাতির হানায় ফি-বছর মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। গড় দাঁড়িয়েছে ১১-য়। আহতের গড়ও ১৫-র বেশি। আর শস্যহানি বাড়তে বাড়তে সাবাড় হচ্ছে হাজার হেক্টরেরও বেশি জমির ফসল। বাড়ি ভাঙার সংখ্যাও বছরে গড়ে হাজারের বেশি। ক্ষতিপূরণ দিতে শুধু পশ্চিম মেদিনীপুরেই বন দফতরের বছরে খরচ হচ্ছে ৫০ লক্ষ টাকা।
এই পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট এ জেলায় দাঁতালদের দামালপনা কী হারে বাড়ছে।
ফি-বছরই দলমা থেকে হাতির দল ঢুকে পড়ছে এ রাজ্যে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বেলপাহাড়ি হয়ে ঢোকার পর চলে যাচ্ছে নানা প্রান্তে। পৌঁছে যাচ্ছে বাঁকুড়ায়। অথচ এ রাজ্যের জঙ্গলেও এখন আকাশমণি, ইউক্যালিপটাসই বেশি। কোথাও কোথাও অবশ্য শাল, মহুলেরও দেখা মেলে। তবে মোটের উপর জঙ্গলেও এখন হাতির খাবার কমছে। তাই হাতির দল রাতের অন্ধকারে খাবারের সন্ধানে জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে পড়ছে মাঠে। ঢুকে পড়ছে গ্রামের ভিতরে। জমির ধান খেয়ে সাবাড় করছে। মাড়িয়ে নষ্ট করছে। বাধা পেলে পাল্টা আক্রমণে তেড়ে আসছে।
রাতের অন্ধকারে আচমকা হাতির সামনে পড়ে জখম হচ্ছেন গ্রামবাসী। হাতির হামলায় ঘর ভেঙে দেওয়াল চাপা পড়েও মারা যাচ্ছেন অনেকে। বন দফতরের একাধিক আধিকারিকের আবার বক্তব্য, অনেক সময়ে গাঁ-গঞ্জের দিকে বাড়িতেও হাড়িয়া যাতীয় পানীয় তৈরি করা হয়। তার গন্ধ আকর্ষণ করে হাতিকে। তার জন্যও কোনও কোনও ক্ষেত্রে সেই ঘর-বাড়ির দিকে ছুটে যায় হাতির পাল। এই কারণে জঙ্গল-লাগোয়া এলাকায় হাড়িয়া জাতীয় পানীয় তৈরি বা মজুত না করতে মানুষজনকে অনুরোধ করাও শুরু করেছে বন দফতর।
এ বছরও হাতির পাল এসে পড়েছে জেলায়। গড়বেতা, লালগড়, শালবনি, কোতোয়ালি থানা এলাকায় ইতিমধ্যেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এ বার আবার দু’টি দলে ভাগ হয়ে এসেছে দলমার দাঁতালেরা। একটি দল ধানঘোরিতে আর অন্যটি বক্সীবাঁধ, চাঁদড়া, পিরাকাটা হয়ে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে জেলার আরও নানা প্রান্তে। দু’টি দল মিলিয়ে এ বার হাতি রয়েছে প্রায় ১৩৫টি। এতগুলি হাতির কারণে এ বার ইতিমধ্যেই শস্যহানি হচ্ছে প্রচুর। গত বছর জেলায় খরা গিয়েছে। ভাল ফলন হয়নি। এ দিকে, বীজ-সার-কীটনাশকের দাম মাত্রাছাড়া হয়ে, সেচ-ব্যয় বেড়ে চাষের খরচও ঊর্ধ্বমুখী। এই অবস্থায় এ বছর একটু ভাল ফসল হতেই যদি হাতিই তা সাবাড় করে, তা হলে তো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ারই জোগাড়।
বন দফতর ক্ষতিপূরণ দেয় বটে, কিন্তু তা নামমাত্র। প্রতি ডেসিমেল জমির শস্যহানি বাবদ মাত্রই ৩০ টাকা। প্রকৃত ক্ষতিপূরণ সম্ভব হয় না। চাষির ক্ষোভ তাই স্বাভাবিক। মাঝেমধ্যেই তাই বন দফতরে বিক্ষোভ হয়। বনকর্মীদের উপর চড়াও হওয়ার ঘটনাও ঘটে। তাই বন দফতর চেষ্টা করে হাতির পালকে জঙ্গলেই আটকে রাখার। কিন্তু হাতির পাল সেখানে খাবেই বা কী? সন্ধে নামলেই জঙ্গল ছেড়ে তাই ঢুকে পড়ে গ্রামে।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় বন দফতরের চারটি ডিভিসন রয়েছে---মেদিনীপুর, রূপনারায়ণ, খড়্গপুর ও ঝাড়গ্রাম। গত ৫ বছরে চারটি ডিভিসনে হাতির হানায় মৃত্যু হয়েছে ৫৫ জনের। আগে হাতির হানায় কারও মৃত্যু হলে ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হত। বর্তমানে তা বেড়ে ১ লক্ষ টাকা হয়েছে। কিন্তু তা-ও নিতান্তই কম। ৫ বছরে হাতির হানায় আহতও হয়েছেন প্রায় ৮০ জন। ৫ বছরে শস্যহানি হয়েছে প্রায় ৭ হাজার হেক্টর জমির। বাড়ি ভেঙেছে সাড়ে ৪ হাজারেরও বেশি।
ফসল নষ্ট, বাড়ি ভাঙচুর, এমনকী মৃত্যু---হাতির প্রতি বিরক্তি তৈরি করছে। সব সময় একটা আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছে জঙ্গল-লাগোয়া গ্রামের মানুষজনকে। এই বুঝি খেতের ফসল নষ্ট করে গেল। এই বুঝি গ্রামে হানা দিল। বাড়ি ভাঙল। সাধারণ মানুষের তাই দাবি, দলমা থেকে আসা হাতির দলকে রাজ্য-সীমাতেই আটকে দিতে হবে। এই দাবিতে আন্দোলনও হয়েছে। সরকারও এক সময়ে ময়ূরঝর্নায় এ ব্যাপারে একটি প্রকল্প তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। যেখানে হাতির খাবার উপযোগী গাছ লাগানো হবে, পানীয় জলের ব্যবস্থা থাকবে। হাতি সেখানেই আটকে থাকবে। কিন্তু সেই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে ফি-বছর বেড়েই চলেছে হাতির হানায় ক্ষতির পরিসংখ্যান। |