আলোর বন্যা সর্বত্র, বাড়ির পুজোগুলির প্রস্তুতিও তুঙ্গে |
চন্দননগর স্টেশন চত্বর থেকে কয়েক হাত দূরে স্টেশন রোডে ঝলমল করছে আলোর আইফেল টাওয়ার। প্রায় ৫২ ফুট উঁচু।
ট্রেনে করে যাঁরা জগদ্ধাত্রী পুজো দেখতে আসছেন, খলিসানি সর্বজনীনের এই আইফেল টাওয়ারের সামনে তাঁদের এক বার দাঁড়াতেই হচ্ছে।
আরও এগোলে আরও আলোর বন্যা।
ফটকগোড়ার কাছে রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে দিল্লির ‘কুতুব মিনার’। এটাও আলোয় তৈরি। তার পর যে দিকেই যাওয়া যায়, কোথাও আলোয় দেখানো হচ্ছে ‘সহজ পাঠ’, কোথাও পরিবেশ নিয়ে সচেতনতার প্রচার। কলুপুকুর ধারে ‘আলোয় ম্যাজিক’। এমন কত যে চমক গোটা শহর জুড়ে ইয়ত্তা নেই।
সপ্তমীতে রাত যত গাঢ় হয়েছে, ভিড় তত বেড়েছে। সামাল দিতে হিমশিম খেয়েছে পুলিশ। তবে, হাসি ফুটেছে পুজো উদ্যোক্তাদের। কারণ, মণ্ডপে ভিড় বেড়েছে। ‘কেন্দ্রীয় জগদ্ধাত্রী পুজো কমিটি’র আওতায় এ বার ১৪২টি বারোয়ারি পুজো হচ্ছে। তবে, এ শহরে বেশ কিছু প্রাচীন বাড়ির পুজোও রয়েছে। যা হয় সাবেক রীতি মেনে।
দুর্গাপুজোর পরেই চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্য যে ভাবে প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়, তা অবশ্য বাড়ির পুজোগুলির ক্ষেত্রে দেখা যায় না। কারণ, সব পুজোই হয় এক দিনে। নবমীতে। |
কোনও বাড়িরই প্রতিমা বারোয়ারিগুলির মতো বড় নয়। বক্সি গলির পালবাড়িতে পুজো হচ্ছে বহু বছর ধরে। পরিবারের লোকজনের দাবি, পুজো প্রায় আড়াইশো বছরের পুরনো। কে চালু করেছিলেন, তা আজ আর বলতে পারেন না কেউ। তবে, বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম সদস্য গোলোকবিহারী পাল বলেন, “আমরা জন্ম থেকেই বাড়িতে পুজো দেখছি। আমরা ছয় ভাই এখন পুজোর যাবতীয় ব্যবস্থা করি।”
সাদা দোতলা বাড়িটায় ঢুকলেই সামনে বিশাল চাতাল। এক ধারে নাটমন্দির। সেখানেই পুজোর এক সপ্তাহ আগে থেকে প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয়। সপ্তমীর দিনে গিয়ে দেখা গেল, প্রতিমার রঙ, সাজসজ্জা সবই শেষ। টাঙানো হচ্ছে সামিয়ানা। কাল, নবমীতে তিন দিনের পুজো সারা হবে বলে জানালেন পরিবারের সদস্যেরা। গোলোকবিহারীবাবুর কথায়, “এটাই আমাদের রীতি। সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমী পুজো একই দিনে হয়। নবমীর সকালে গঙ্গায় ঘট স্নান করিয়ে পুজোর সূচনা হয়। অষ্টমী পুজোর শেষে হয় কুমারী পুজো।”
বারাসত গেট অঞ্চলের চক্রবর্তীপাড়ার অধিকারী বাড়ির পুজো হয় বেশ জাঁকজমক করে। এখানকার পুজোর বয়স অবশ্য বেশি নয়। এ বার ৩৫ বছরে পড়ল পুজো। গৃহকর্তা জয়ন্ত অধিকারী প্রতিবার নিজের হাতে প্রতিমা তৈরি করেন। তাঁর কথায়, “এক বার এক সাধু মাকে পরিবারের সকলের মঙ্গলের জন্য বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো করতে বলেছিলেন। মায়ের ইচ্ছাতেই পুজো শুরু হয়।”
ওই এলাকারই নন্দীপাড়ার নন্দীবাড়ির পুজো দীর্ঘদিনের। পরিবারের সুশান্ত নন্দীর দাবি, “আমাদের পুজো প্রায় ২০০ বছরের পুরনো। আমাদের পূর্বপুরুষ বিহারীলাল নন্দী ছিলেন বড় ব্যবসায়ী। তিনিই পুজোর প্রচলন করেন।’’ এখানে অবশ্য ষষ্ঠীর দিন ঘট পাতা হয়। তার মধ্যেই চলতে থাকে প্রতিমা তৈরির শেষ পর্বের কাজ।
ওই বাড়ি থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে রয়েছে আরও একটি পুরনো বাড়ির পুজো। যা এলাকায় ‘ঘটকবাড়ির পুজো’ হিসাবে খ্যাত। মূল দরজা দিয়ে ঢুকলেই সামনে বিশাল দালান। সেই দালানেই পুজোর আয়োজন। সপ্তমীর দিন সকালে জোরকদমে চলছিল প্রতিমা তৈরির কাজ। পরিবারের সদস্যেরা নিশ্চিত, আজ, অষ্টমীর মধ্যেই সব আয়োজন সারা হয়ে যাবে। সকলেই কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় থাকেন। কিন্তু প্রতিবার পুজোয় তাঁরা মিলিত হন। সকলের উদ্যোগে এখনও টিকে রয়েছে এই পুজো। যা অন্তত ৩০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন বলে দাবি পরিবারের সদস্য ইন্দ্রতোষ ঘটকের।
ইতিমধ্যেই প্রতিটি বাড়ি আত্মীয়-স্বজনে সরগরম হয়ে উঠেছে। বাড়ির পুজো হলেও সব ক্ষেত্রেই সামিল হন পাড়া-পড়শিরাও। সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্যও নবমীতে এই সব বাড়ির দ্বার অবারিত। |