প্রচুর ভর্তুকির পরেও সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে ডিজেল, কেরোসিন ও রান্নার গ্যাস বিক্রি করতে গিয়ে দিনে ৩৩৩ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থাগুলির। এই সঙ্কট কাটাতে তিনটি জ্বালানিরই দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই বলে মনে করছে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে সংসদের শীতকালীন অধিবেশনের আগেই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রিগোষ্ঠীর বৈঠক ডাকার অনুরোধ জানালেন পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী জয়পাল রেড্ডি।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর যখন পেট্রোলের দাম ৩.১৪ টাকা বাড়ানো হয়েছিল তখন এক ডলারের বিনিময়মূল্য ছিল ৪৮ টাকা। সেটাই ৪৯ টাকায় পৌঁছে যাওয়ায় কাল থেকে তেল সংস্থাগুলির বার্ষিক লোকসান বেড়ে গিয়েছে ২৪ হাজার কোটি টাকা। এর উপর লিটারপ্রতি ডিজেলে ৯.২৭ টাকা, কেরোসিনে ২৬.৯৪ টাকা এবং রান্নার গ্যাসের প্রতিটি ১৪.২ কেজি সিলিন্ডারে ২৬০.৫০ টাকা লোকসান হচ্ছে তাদের। কাজ চালানোর অর্থ জোগাড় করতেও মুশকিলে পড়তে হচ্ছে তাদের। নিতে হচ্ছে বিপুল ঋণ। পরিস্থিতি এমন যে খোদ পেট্রোলিয়াম মন্ত্রীই আজ বলেছেন, “বিদেশি ব্যাঙ্ক তো বটেই, ভবিষ্যতে দেশীয় ব্যাঙ্ক থেকেও ঋণ পাওয়া শক্ত হয়ে পড়বে সংস্থাগুলির পক্ষে।”
পেট্রোলের দাম বাড়ানো নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে তেল সংস্থাগুলি। বাকি তিন জ্বালানির দাম বাড়ানোও যে একান্ত জরুরি, সে কথা বোঝাতে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী জানান, কম দামে ডিজেল-কেরোসিন-গ্যাস বিক্রি করতে গিয়ে চলতি আর্থিক বছরে ইন্ডিয়ান অয়েল, হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়াম ও ভারত পেট্রোলিয়ামের মিলিত লোকসান দাঁড়াবে ১ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এই পরিস্থিতি সামাল দিতেই মন্ত্রিগোষ্ঠীর বৈঠক চেয়েছেন রেড্ডি। ওই মন্ত্রিগোষ্ঠীর শীর্ষে রয়েছেন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাঁর কাছে বৈঠক ডাকার অনুরোধ জানিয়েছেন রেড্ডি। ২২ নভেম্বর সংসদের অধিবেশন শুরুর আগেই ওই বৈঠক হতে পারে বলে আশা করছেন পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী। বৈঠকে ডিজেল, কেরোসিন ও রান্নার গ্যাস, তিনটিরই দাম বাড়ানোর পক্ষে সওয়াল করা হবে বলে স্পষ্ট জানিয়েছেন তিনি।
তবে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা যে ‘সহজ হবে না’, তা-ও স্বীকার করেছেন রেড্ডি। বিভিন্ন বিষয়ে ইউপিএ শরিকদের মধ্যে সর্বসম্মতি গড়ে তোলাই মন্ত্রিগোষ্ঠীর অন্যতম লক্ষ্য। কিন্তু এর আগে এক-একটি পরিবারকে বছরে ৪-৬টির বেশি সিলিন্ডারে ভর্তুকি না দেওয়ার প্রস্তাব আনা হলে তৃণমূল, ডিএমকে, ন্যাশনাল কনফারেন্সের মতো শরিকরা তা আটকে দিয়েছিল। এ বার তিন জ্বালানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে শরিকরা সহজে সায় দেবে কি না, তা নিয়ে যথষ্ট সংশয় রয়েছে। বিশেষ করে আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে যেখানে পেট্রোলের দাম অন্তত ১ টাকা ৮২ পয়সা বাড়ার সম্ভাবনা।
পেট্রোলের দাম বাড়ার ইঙ্গিত পেয়ে কালই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের আর্থিক নীতির এক দফা সমালোচনা করেছে বিজেপি। জবাবে রেড্ডি ও পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের সচিব জি সি চতুর্বেদী আজ মনে করিয়ে দেন, গত বছর জুনের পর থেকে সরকার পেট্রোলের দাম নিয়ন্ত্রণ করে না। তাতে অবশ্য চিড়ে ভিজছে না। আজও প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক নীতিকেই নিশানা করেছে বিজেপি।
প্রশ্ন উঠছে, ক্ষমতায় থাকলে বিজেপি বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতিতে কী করত? প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিন্হার বক্তব্য, বৃদ্ধির পিছনে ছোটা আর ঘাটতি কমানো দু’টো একসঙ্গে চলতে পারে না। উৎপাদন শিল্প যখন মার খাচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি চরম সীমায়, এই সময় আম-আদমির উপর চাপ বাড়ানো ভুল অর্থনীতি। যশবন্তের দাবি, এনডিএ আমলে সহনীয় মুদ্রাস্ফীতি বজায় রেখেই বৃদ্ধি সুনিশ্চিত করা হয়েছিল। তাই এত ঘন ঘন দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হয়নি। গত বছর পেট্রোলিয়াম ক্ষেত্র থেকে কর এসেছে ১.৩৫ লক্ষ কোটি টাকা ও ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ৪০,৪৩০ কোটি টাকা। তাই তেল সংস্থাগুলির লোকসান নিয়ে সরকারের যুক্তি ধোপে টেকে না।
কেন্দ্রের আর্থিক নীতির প্রতিবাদে ২০১২-র গোড়ায় সারা দেশে ধর্মঘট ডাকার পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি। ফের পেট্রোলের দাম বাড়ার ইঙ্গিত পেয়ে সেই ধর্মঘটের আহ্বানেরই পুনরাবৃত্তি করেছে তারা। এআইটিইউসি নেতা তথা সিপিআই সাংসদ গুরুদাস দাশগুপ্ত কলকাতায় বলেন, “ওষুধ ও সার তৈরিতেও পেট্রোল লাগে। এর দাম বাড়লে খাদ্যদ্রব্যের দামও বাড়বে। কেন্দ্র গত বছর আয়করে ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাড় দিতে পেরেছে অথচ পেট্রোলের করে ছাড় দিয়ে তেল সংস্থার লোকসান সামলাতে পারে না!” সিটুর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি তথা সিপিএম সাংসদ শ্যামল চক্রবর্তীও বলেন, “বাজেট-তথ্যই বলছে, তেল থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা লাভ হয়েছে সরকারের। সাধারণ মানুষের ভার লাঘব করার জন্য এই করে ছাড় দেওয়া যেতে পারে তো। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগে এই কর তোলার জন্য সরব হতেন। এখন আর উচ্চবাচ্য করছেন না!” এসইউসি-র সাধারণ সম্পাদক প্রভাস ঘোষও এক বিবৃতিতে বলেছেন, পেট্রোলের দাম বাড়লে অত্যাবশ্যক পণ্যের দাম বাড়বে। সাধারণ মানুষ আরও দুর্দশায় পড়বেন। |