পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র দিল্লি এলেই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁকে বলছেন, ‘অমিত, অবিলম্বে বাজেট করে কর চাপাও। জনপ্রিয় ঘোষণা আপাতত বন্ধ রাখো, রাজকোষে টাকা নেই। কেন্দ্র আর্থিক প্যাকেজ দেবে কী ভাবে, যদি তুমি খরচ না কমাও!’ দক্ষিণ ফ্রান্সের এই সমুদ্র শহর থেকে প্রায় সেই একই বার্তা যেতে চলেছে গ্রিসের উপপ্রধানমন্ত্রী তথা অর্থমন্ত্রী অধ্যাপক এভানজেলোস ভেনিজিলোস এবং ইতালির অর্থমন্ত্রী জিউলিও ট্রেমন্টির জন্য। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ জি ২০-র মঞ্চে সবাই ইতালির প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুস্কোনি এবং গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী জর্জ পাপান্দ্রিউকে বলবেন, ইউরো-জোনের অর্থনৈতিক সঙ্কটে আমরা সবাই পাশে আছি। কিন্তু আপনারা আপনাদের অর্থমন্ত্রীদের আপাতত দাতব্য বন্ধ রাখতে বলুন।
সেই সতর্কবার্তায় কতটা কাজ হবে, তা অবশ্য এখনই বিরাট প্রশ্নচিহ্নের মুখে। কারণ, গত মাসের শেষে ব্রাসেলসের বৈঠকে গ্রিসের জন্য যে ‘ত্রাণ প্যাকেজ’ ইউরো জোনের ১৭টি দেশের সর্বসম্মতিতে ঠিক হয়েছে, তা নেওয়া হবে কি না, সে ব্যাপারে দেশে গণভোট নিতে চান পাপান্দ্রিউ। ‘ত্রাণ প্যাকেজে’ এক দিকে যেমন গ্রিসকে যারা ঋণ দিয়েছে, তাদের ৫০ শতাংশ ঋণ (যার পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলার) মকুব করে দিতে বলা হয়েছে, তেমনই পাপান্দ্রিউর সরকারকে বলা হয়েছে, কোমরের কষি শক্ত করার জন্য। সমালোচকদের মতে, ব্যাঙ্ক ও ঋণদাতাদের দিকে তাকিয়ে (অর্থাৎ তারা যাতে দেওয়া ঋণের একটা বড় অংশ এখনই ফেরত পায়) সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণমূলক প্রকল্পে কোপ দিতে বলা হয়েছে প্যাকেজে। যেটা স্বাভাবিক ভাবেই আমজনতার না-পসন্দ। আর রাজনীতির দিকে তাকিয়ে পাপান্দ্রিউ বন্দুক নিজের ঘাড়ে রাখছেন না। আর্থিক প্যাকেজ নেওয়ার আগে মতামত নিয়ে নিতে চাইছেন দেশের মানুষের। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গণভোটের ফল যদি ‘না’ হয়, তা হলে আরও গভীর হবে ইউরোপের আর্থিক সঙ্কট।
গণভোটের আগেও অবশ্য একটা পর্ব আছে। নিজের দেশের সংসদে গণভোট নেওয়ার সিদ্ধান্ত পাশ করাতে হবে পাপান্দ্রিউকে। শুক্রবার সেই ভোট। পাপান্দ্রিউর প্রস্তাব পাশ হলে তো গণভোটের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবেই। পাশ না হলেও বিপত্তি। কারণ সে ক্ষেত্রে সরকার পড়ে যাবে। (এমনিতেই ৩০০ আসনের গ্রিস সংসদে শাসক পাসোক সোশ্যালিস্ট পার্টির সদস্য সংখ্যা ১৫২) তখন আবার নতুন অস্থিরতা। যা ছড়াতে পারে ইউরো জোনের অন্যান্য দেশেও।
ইতালির সমস্যাও কম গভীর নয়। বল্গাহীন হরির লুটের জেরে তার মাথার উপর ২ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি ডলার ঋণের বোঝা। তাদের সরকারি বন্ডে সুদের হারও বেশি। ফলে ঋণ সঙ্কট অচিরে আরও বাড়তে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা।
এই রকমই এক ‘কঠিন’ পরিস্থিতিতে কানে বসছে জি ২০-র দু’দিনের বৈঠক। সেই বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য বিশেষ বিমানে চড়ার আগে আজ দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বললেন, “বিশ্ব অর্থনীতিতে ঠিক রাস্তায় নিয়ে আসার জন্য জি ২০-র মঞ্চ থেকে ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী বার্তা দেওয়া জরুরি।” কিন্তু সেই ‘বার্তা’ কতটা দেওয়া যাবে, তা নিয়ে বিশ্বের অর্থনৈতিক মহলে জোর জল্পনা।
অর্থ সাহায্য চাওয়া হয়েছে চিন, রাশিয়া, জাপানের কাছ থেকে। কিন্তু চিন যে সহজে দাতাকর্ণ হবে না, সেটা বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না। হাতের মুঠো আলগা করার আগে হু জিনতাও চাইবেন কূটনৈতিক দর কষাকষি করে ইয়েনের দাম বাড়িয়ে নিতে।
তবে এটাও ঠিক যে, চিন জানে তাদের অর্থনীতি ভীষণ ভাবে রফতানি নির্ভর। ফলে আমেরিকা ও ইউরোপের বাজারে ধস নামলে চিনের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিও জোর ধাক্কা খাবে। তাই এর আগে জি ২০-তে মুদ্রা যুদ্ধ নিয়েও যেমন এক পা এগিয়ে চিন দু’পা পিছিয়ে গিয়েছিল, এ বারও সেটাই করবে কি না, তা দেখতে চায় পশ্চিমী দুনিয়া।
ইউরোপের ‘চিন’ বলে অধুনা পরিচিত জার্মানি ব্রাসেলসের বৈঠকে রাগে গজরাচ্ছিল আমি কেন তোমার বোঝা বইতে যাব! শেষমেশ দুনিয়ার চাপে তাকে মেনে নিতে হয়েছে, আপাতত সেবাই পরম ধর্ম। কিন্তু বাস্তবে তারা কতটা এগিয়ে আসবে, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের একটা অংশের সংশয় রয়েছে। অন্য অংশটি আবার বলছে, শেষ পর্যন্ত ‘ইউরো’ নামক মুদ্রাটিই যদি লোপ পায়, অর্থনীতির সেই ‘পুনর্মূষিক ভব’ অবস্থায় জার্মানিরই বা কী লাভ? এই অবস্থায় ব্যয়সঙ্কোচের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার জন্য গ্রিসকে প্রবল চাপ দিচ্ছেন জার্মানির চ্যান্সেলার আঙ্গেলা মেরকেল। সঙ্গে জি ২০-র অন্যান্য দেশ। সাঁড়াশি আক্রমণে গ্রিসের কাছে জানতে চাওয়া হচ্ছে, কেন এই গণভোট। তাকে বলা হচ্ছে, আমরা পাশে নিশ্চয়ই দাঁড়াব, কিন্তু তোমাকেও স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তা না হলে আর্থিক প্যাকেজটাই তো জলে যাবে।
সব মিলিয়ে কলকাতা-দিল্লি টানাপোড়েনের ছবিটাই যেন দু’দিনের জন্য উঠে আসছে কানে। আসলে সঙ্কটের একই সুতোয় বাঁধা সকলে! |