‘গদ্দারদের’ ক্ষমা করতে চায় না পাকিস্তান
জুলফিকার বাট বলছিলেন, “আমাদের পরিবারের জন্য আজ সত্যিই খুব মিশ্র ভাগ্যের দিন। নাতি জন্মাল। আজ আমাদের কত আনন্দ করার কথা। কিন্তু তার আধ ঘণ্টার মধ্যেই ছেলেকে নিয়ে লন্ডনের আদালতের রায়ের খবর পেলাম। কী যে বলব, কিছু বুঝে উঠতে পারছি না।”
জুলফিকার বাট হলেন সলমন বাটের বাবা। সলমনের আগের সন্তান ছিল মেয়ে। এ বার ছেলে। পরিবারে আজ খুশির বন্যা বয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু খুশির রোশনাইয়ের বদলে সেখানে বিষাদের করুণ সুর।
রায় শুনে আদালত ছাড়ছেন বাট ও আসিফ। লন্ডনে। ছবি: এপি ও এএফপি।
পাকিস্তানের ক্রিকেটভক্তদের মধ্যে বা ক্রিকেটমহলে কিন্তু কোনও শোকের ছায়া-টায়া নেই। আমজনতা বেশ খুশিই যে, দেশের সম্মান যারা ডুবিয়েছিল, নিজেদের পকেটে পাউন্ড ভরার জন্য দেশকে যারা বিক্রি করে দিয়েছিল, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে। বহির্বিশ্বে একটা ধারণা রয়েছে যে, মহম্মদ আমেরের জন্য পাকিস্তানের মানুষের খুব সহানুভূতি রয়েছে। যেহেতু আমেরের বয়স খুব কম এবং তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে এ রকম একটা আবেগপূর্ণ কাহিনি বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে। একেবারেই ভুল ধারণা। খুব জোর হলে এটুকু বলা যেতে পারে যে, বাট আর আসিফকে নিয়ে যেমন দাউদাউ আগুন জ্বলছে, আমেরের ক্ষেত্রে ক্ষোভ হয়তো তার চেয়ে সামান্য কম। কিন্তু সেটা এত কম নয় যে, কেউ প্রার্থনা করছে বাকি দু’জনের শাস্তি হোক, আমের ছাড় পেয়ে যাক। পাক জনতার চোখে ওরা ‘গদ্দার’। সহানুভূতির প্রশ্ন নেই। বরং সাজা ভোগ করার পরেও ওরা দেশে ফিরতে পারবে বলে কল্পনা করতে পারছি না।
পাকিস্তানের বেশির ভাগ ক্রিকেটভক্তেরই এক মন্তব্য, “পাকিস্তান ক্রিকেটে অনেক কলঙ্ক হয়েছে। এখানে বিতর্কের কোনও শেষ নেই। ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগ সেই কবে থেকে চলছে। যাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে তাদেরও এমনকী ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। দিব্যি তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ রকম একটা কঠোর দৃষ্টান্ত স্থাপন করা খুব দরকার ছিল।” পাক ক্রিকেটমহলও সামনের দিকে তাকাতে চায়। লর্ডসগেটের পর কলঙ্কিত ক্রিকেটারদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর এই সময়ে অনেক তরুণ ক্রিকেটার উঠে এসেছে। আজহার আলি উঠে এসেছে। আসাদ শফিক এসেছে। আডনান আকমল এসেছে। এরা সব এক-এক জন খুবই প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন ক্রিকেটার। পাকিস্তানে প্রতিভার তো কোনও দিনই অভাব ছিল না। আজও নেই। দরকার শুধু বিতর্ক, প্রলোভন আর অপরাধ থেকে মুখটা ঘুরিয়ে ক্রিকেটমুখী করে দেওয়া। বাট আর আসিফের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিতে সেই শাপমোচনটা যদি এ বার ঘটে! পাক ক্রিকেটের সবথেকে বড় বিস্ফোরণটা যখন ঘটছে, তখন নতুন পাক ক্রিকেট বোর্ডের বয়স মাত্র তিন দিন। নতুন বোর্ড প্রধান হয়ে এসেছেন চৌধুরি জাকা আশরাফ। তিনি যে নতুন স্টান্সই নিন না কেন, বাটদের দিকে বন্ধুত্বের হাত যে আর বাড়িয়ে দেওয়া হবে না সেটা পরিষ্কার। কলঙ্কিত ক্রিকেটাররা যে লন্ডনে আদালতে লড়ছিলেন, সেটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ক্ষমতায়। নিজেদের আইনজীবী ঠিক করে। বোর্ড এর মধ্যে ঢোকেনি।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি: জঘন্যতম অপরাধ। দোষীদের
যতটা সম্ভব কড়া শাস্তি দেওয়া উচিত।
ললিত মোদী: ক্রিকেটাররা শুধু নয়, প্রশাসকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে
আম্পায়াররাও গড়াপেটা করে।
জাহির আব্বাস: ভুল করলে তার দাম
চোকাতেই হয়।
রশিদ লতিফ: মাজহার মেহমুদ এবং মাজহার মজিদ আমাদের প্লেয়ারদের
জন্য ফাঁদ পেতেছিল।
মাইকেল ভন: গোটা ক্রিকেটবিশ্বের উপর এর
প্রভাব পড়বে।
আমির সোহেল: স্পট ফিক্সিং কাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পরেই পাকিস্তান বোর্ডের
উচিত ছিল প্লেয়ারদের দেশে ফিরিয়ে এনে আমাদের আইন অনুযায়ী বিচার করা।
sকিন্তু মনের মধ্যে লর্ডসগেট যত রিওয়াউন্ড করছি, ততই মনে হচ্ছে, আজ পাক বোর্ড যতই নিরপেক্ষতা দেখানোর চেষ্টা করুক, ঘটনাটা এত দূর গড়ানোর জন্য বোর্ড কর্তাদের অপদার্থতা অনেকটাই দায়ী। না হলে কুখ্যাত সেই লর্ডস টেস্টের ঠিক আগেই শাহিদ আফ্রিদি কিন্তু এই নিয়ে সবাইকে সতর্ক করেছিল। তা-ও আবার কিনা খোদ টিম মিটিংয়ে সমস্ত ক্রিকেটারের সামনে। ট্যুর ম্যানেজার ইওয়ার সঈদও তখন সেখানে বসা। মাজহার মজিদের নাম নিয়েই শাহিদ বলেছিল, আমাদের কয়েক জন প্লেয়ার ওর সঙ্গে দুমদাম বেরিয়ে যাচ্ছে। শপিং মলে যাচ্ছে। রেস্তোরাঁয় খেতে চলে যাচ্ছে। এটা বন্ধ হওয়া উচিত। লোকটার সঙ্গে এত মেলামেশা করাটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। ম্যানেজারকে এর পর আলাদা করেও পদক্ষেপ নিতে বলেছিল শাহিদ। বলেছিল, এখনই মজিদের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করার ব্যবস্থা করুন।
ঘরে বসে বানানো কোনও গল্পগাছা নয়। একদম সত্যি কথা। আফ্রিদির সেই বক্তব্য টিম মিটিংয়ে বলা, তাই রেকর্ডেড আছে বলেই আমার বিশ্বাস। আমিও ওই সফরে টিমের সঙ্গে ছিলাম। কিন্তু প্রথম দু’টো টেস্টের পর দেশে ফিরে আসি। লর্ডস টেস্টটা ছিল চতুর্থ। দেশে বসেই আমি টিম মিটিংয়ে আফ্রিদির এই চাঞ্চল্যকর বক্তব্য নিয়ে একটা ‘স্টোরি’ লিখি। আর সেই লেখা ছেপে বেরোনোর পরের দিনই কিনা লন্ডন থেকে ফোন চলে এল! কার? না, আজহার মজিদের। মাজহার মজিদের ভাই। ফোনে বিশ্রী ভাষার সঙ্গে যত রকম হুমকি দেওয়া যায় দিল। বলল, এ সব লিখছেন! আপনার বিরুদ্ধে মামলা করব আমরা। এই করব, সেই করব।
এক-এক সময় নিজেকে প্রশ্ন করছি, এই সলমন বাট! মহম্মদ আসিফ! এদের ক্রিকেট কত কভার করেছি। কখনও পাকিস্তানকে ম্যাচ জেতালে আমরাই তো লিখেছি, এদের ব্যাটে বা বলে দেশের জয়। আজ এ রকম একটা চাঞ্চল্যকর, বেনজির রায়ের দিনে কোথাও কি একটুও খারাপ লাগছে না?
উত্তর হচ্ছে, না, খারাপ লাগছে না। বরং যত বারই নিজের মনকে জিজ্ঞেস করছি, ততই ভেসে উঠছে লর্ডসের সেই কলঙ্কিত নো বল। অবলীলাক্রমে দেশকে বিক্রি করে পকেটে পাউন্ড ভরার সেই পৈশাচিক ছবি। আর তত বিচারের বাণি কেঁদে ওঠার মতো শুনতে পাচ্ছি কেউ যেন বলে উঠছে, পাপ করলে তো প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে!

(লেখক পাকিস্তানের নামী ক্রিকেট-লিখিয়ে এবং টিভি বিশেষজ্ঞ)




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.