নোয়ার তরীটি ক্রমেই ভরিয়া উঠিতেছে। হিসাব অনুসারে, গত ৩১ অক্টোবর এই গ্রহ-তরণীতে সাতশত কোটিতম মানুষ-সন্তান পদার্পণ করিল। জনতার ভারে তরীটি এখনই ডুবিবে, এমন কোনও আশু বিপর্যয়ের আভাস নাই যদিও, কিন্তু দিগন্তে একটি সংকেত বিদ্যমান। রাষ্ট্রপুঞ্জ জানাইয়াছে, চলতি শতকের অন্তিমে বিশ্বের জনসংখ্যা হইবে এক সহস্র কোটি। যদি জন্মহার প্রত্যাশিত মানের তুলনায় সামান্য অধিক হইয়া পড়ে, তাহা হইলে সেই সংখ্যা পনেরো শত কোটি স্পর্শ করাও বিচিত্র নহে। জন্মিলে মরিতে হইবে, সত্য, কিন্তু, বাঁচিতেও হইবে। তাহাও এক দুঃখ। এক বার বাঁচিলে বাঁচিবার জন্য যাহা যাহা করণীয়, সবই করিতে হইবে। তাহার জন্য যে পরিমাণ প্রাকৃতিক রসদ প্রয়োজন, তাহার সংস্থান করিতে হইবে, এবং সেই সম্পদের ব্যবহারও হইবে বিপুল। সংকটটি সেখানেই। এক সহস্র কোটি বা তাহার অধিক মানুষের ব্যবহারের উপযোগী প্রাকৃতিক সম্পদ কি এই ধরাতলে উপস্থিত? পরিবেশ ধ্বংসের পালা যেমন বিপুল হারে চলিতেছে, তাহাতে সেই বিষয়ে সন্দেহ ক্রমেই গভীর। পরিবেশবিদগণ শেষের সে দিন-এর হুঁশিয়ারি দিয়াছেন। পাশাপাশি, উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে দীর্ঘ করিতেছে, মৃত্যুহারও নিয়ন্ত্রণে রাখিবার আপ্রাণ প্রয়াস চলিতেছে।
ভারতের পক্ষে এই শঙ্কা সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল এই রাষ্ট্র ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক আসরে বৃহৎ শক্তি হইয়া উঠিবার দাবিদার। অথচ, জনসংখ্যার চাপ ক্রমেই যে বিস্ফোরক অবস্থার সৃষ্টি করিতেছে, তাহারও কার্যকর সমাধান পাওয়া জরুরি। কী ভাবে, সেই উত্তরের সন্ধান পূর্বে নানা ভাবে হইয়াছে। সেই অভিজ্ঞতা হইতে এই সত্যটি উঠিয়া আসিয়াছে যে, বলপূর্বক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি পৃথিবীর অন্য আরও নানা স্থানের ন্যায় ভারতেও সফল হইবার আশা ক্ষীণ। ভারতে গণতান্ত্রিক বোধ জনচেতনার গভীরে প্রোথিত। ফলে, জন্মহার নিয়ন্ত্রণের কর্মসূচিকে জোর করিয়া চাপাইবার বন্দোবস্ত হইলে জনতার পক্ষে তাহা প্রত্যাখ্যান করাই স্বাভাবিক। এই দেশের ইতিহাস তেমনই সাক্ষ্য দেয়। একমাত্র পার্টি-চালিত চিনে বলপূর্বক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ফলদায়ী হইয়াছিল, কিন্তু বিবিধ তিক্ত পরিস্থিতির কারণে চিনও সেই বলপ্রয়োগের পথ হইতে সরিবার আভাস দিতেছে। অন্য পথটি হইল চেতনা। জনবিস্ফোরণ হইলে কী কী হইতে পারে, এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সুফলগুলিই বা কী কী, সেই বিষয়ে একটি চেতনা। চৈতন্যের এই প্রসারটি আবার শিক্ষার সহিত সমানুপাতে জড়িত। শিক্ষার প্রসার ঘটিলে এই চেতনাও ব্যাপ্তি লাভ করে, শিক্ষার অভাবে তাহার বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়। বিভিন্ন ধনী এবং উন্নত রাষ্ট্রে এই বিষয়টি দেখা গিয়াছে। পরিস্থিতি এমনই যে পৃথিবীর কিছু বিত্তবান, এবং শিক্ষার হারে উন্নত অবস্থানে থাকা রাষ্ট্র জন্মহার শঙ্কাজনক ভাবে কমিয়া যাইবার কারণে চিন্তিত। ভারতেরও দক্ষিণাংশে বলপ্রয়োগ না-করিয়াই জন্মহার নিয়ন্ত্রণ করিবার কার্যে সুফল পাওয়া গিয়াছে। সুতরাং, প্রথমত শিক্ষা এবং তাহার সহিত জনবিস্ফোরণ-সংক্রান্ত চেতনার উন্মেষ জরুরি। ভারতে তো বটেই, এই কথাটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনের ক্ষেত্রেও সত্য। সাতশত কোটিতম মনুষ্য-সন্তানটি সেই বোধ লইয়াই বাঁচিয়া উঠুক। |